সৌরভ গাঙ্গুলীর জীবনী
ক্রিকেটকে যিনি আন্তর্জাতিক স্তরে পৌঁছে দিয়েছেন, এই মুহূর্তে ক্রিকেট বিশ্ব যাঁকে বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বাঁহাতি ব্যাটসম্যানের স্বীকৃতি দিয়েছে, জীবনের প্রথম দিন থেকে অসংখ্যবার হারতে হারতে হারের কিনারা থেকে যিনি ফিরে এসেছেন সাফল্যের স্বর্ণশিখর। প্রেগনে, তিনি হলেন সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়।
বুক চিতিয়ে লড়াই করে বারবার রঙ্গমঞ্চে ফিরে আসার এত অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়। একদা অস্বীকার করার বিন্দু মাত্র স্থান নেই যে, তিনি হলেন ভারতে সর্বকালের সেরা অধিনায়ক। বিচক্ষণ বুদ্ধি এবং রাজকীয় ঔদ্ধত্য নিয়ে বিপক্ষ দলকে শাসন করেছেন। আজ যে ভারতীয় ক্রিকেট, সারা বিশ্বে অভ্যস্ত সমীহ আদায় করছে, তার অন্তরালে আছে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের লড়াকু মেজাজ। তিনিই প্রথম বিদেশীর চোখে চোখ রেখে কথা বলেছেন। বিদেশী অধিনায়ককে দাঁড় করিয়ে রেখেছেন টস করানোর জন্য। অহংকার আর রাজকীয় মহিমায় শাসন করেছেন ক্রিকেট বিশ্বকে। বাঁ হাতি খেলোয়াড় হিসাবে সৌরভের কোনো তুলনা নেই। ব্যাটিং এর পাশাপাশি মিডিয়াম পেসার হিসাবে যথেষ্ট খ্যাতি অর্জন করেছেন। আর তাঁর ক্রিকেটার মস্তিষ্ক ও লড়া মেজাজকে বিশ্বে বিভিন্ন দেশের ক্রীড়া সমালোচকরা বারবার কুর্নিশ
সৌরভের জন্ম হয় ১৯৭২ সালের ৮ই জুলাই শহর কলকাতায়। কৃতি ছাত্র হিসেবে পড়াশোনা করেছেন সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে। ২০৬ তম ক্রিকেটার হিসাবে টেস্টে আত্মপ্রকাশ করেন লর্ডসে ১৯৯৬ সালের ২০ জুন। এর পূর্বে সৌরভের ওপর অনেক কর ঝাপটা বরো গেছে। অন্য কেউ হলে হয়তো খেলার জগতকে বিদায় জানিয়ে অন্য কোথাও চলে যেতেন। পারিবারিক ব্যবসা সামলাতেন। কিন্তু সৌরভের রক্তে ছিল ক্রিকেট, তাই বারবার তিনি খেলার মাঠে ফিরে এসেছেন, অপমানিত হয়েছেন, দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই করেছেন, হাজার লক্ষ মানুষের সহানুভূতি আদায় করেছেন, জ্বলে উঠেছেন বীর বিক্রমে। তাই বলা হয় অপরাজেয় পৌরুষের আর একনাম সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়। এবিষয়ে অস্বীকার করার কিছু নেই। উচ্চবিত্ত পরিবারে পৃথিবীর আলো দেখেছেন সৌরভ। বাড়িতে খেলার বাতাবরণ ছিল। বাবা চন্ডী গঙ্গোপাধ্যায় ছিলেন বিখ্যাত ক্রিকেট প্রশাসক। দাদা স্নেহাশিষ গঙ্গোপাধ্যায়ও ছিলেন প্রখ্যাত ক্রিকেটার। ছোটোবেলা থেকেই ক্রিকেটের বাতাবরনে বেড়ে উঠেছেন সৌরভ। ছোটোবেলা থেকেই সৌরভ তাই অনায়াসে ক্রিকেট খেলায় অংশ নিয়েছেন।
ইডেনে রনজি ট্রফির ফাইনাল । তার আগে একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটে গেল। তখন বাংলার অধিনায়ক ছিলেন সম্বরণ বন্দ্যোপাধ্যায় । তিনি সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়কে মিডল অর্ডারে খেলাতে চাইলেন। তুমুল তর্কাতর্কি শুরু হল । বাংলায় তখন প্রতিষ্ঠিত ব্যাটসম্যানদের ছড়াছড়ি। কাকে বাদ দিয়ে সৌরভকে ঢোকানো হবে? শেষ পর্যন্ত সম্বরণের চাপে সরে যেতে হল দাদা স্নেহাশীস গাঙ্গুলিকে। সি. এ. বি-র তৎকালীন সহসভাপতি চন্ডী গঙ্গোপাধ্যায় বাড়ি ফিরলেন খুশী এবং দুঃখের বোঝা মাথায় নিয়ে। মহারাজের জন্য আনন্দ আর স্নেহাশীসের জন্য দুঃখ ।
১৯৮৯ সালে রনজি ফাইনালে কোশেনটে বাংলা চ্যাম্পিয়ান হয়। ২২ বলে সৌরভ করেছিলেন ২৩ রান। ছোট্ট এই ইনিংসের অবদানের কথা হয়তো অনেকে ভুলে গেছেন। কিন্তু ক্রীড়া সমালোচকরা বলে থাকেন, সৌরভ তখন থেকেই জাতীয় নির্বাচকদের দৃষ্টি কেড়ে নিয়েছিলেন। ঘরোয়া ক্রিকেটে ধারাবাহিকভাবে ভালো খেললেন। ১৯৯১-৯২ সালে অস্ট্রেলিয়া সফরে যাবার সুযোগ পেলেন। এই সফরে গিয়ে সৌরভের অভিজ্ঞতা হল। তিনি বুঝতে পারলেন, কোনো এক অজ্ঞাত কারণে সহখেলোয়াড়রা তাঁর সঙ্গে সহযোগিতা করছেন না। এমনকি সিনিয়ার ক্রিকেটাররাও প্রচন্ড অসহযোগিতা করছেন। ত্রিদেশীয় একদিনের সিরিজে সান্ত্বনা পুরস্কারের মতো একটি মাত্র ম্যাচে খেলার সুযোগ পেলেন। ব্রিসবেনে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে সৌরভকে নেওয়া হল। কোনোরকম মানসিক প্রস্তুতি ছিল না। এই প্রথম বিশ্বক্রিকেটের অঙ্গনে তাঁর আত্মপ্রকাশ। ৩ রানে প্যাভিলিয়নে ফিরে এলেন। নির্বাচকরা সতেরো বছরের কিশোরকে অন্ধকারে নিক্ষেপ করলেন। ভাবতে অবাক লাগে শচীন তেন্ডুলকর জীবনে প্রথম দুটি একদিনের ম্যাচে শূন্য করেও তৃতীয় ম্যাচে জায়গা পেয়েছিলেন, আর সৌরভকে বাতিলের খাতায় ফেলে দেওয়া হল ।
অন্য কেউ হলে হয়তো আর লড়াইয়ের ময়দানে আসতে পারতেন না। কিন্তু সৌরভ ছিলেন অনমনীয় দৃঢ়তার প্রতীক। ১৯৯৫ সালে জাতীয় নির্বাচক হলেন সম্বরণ বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর অক্লান্ত চেষ্টায় ১৯৯৬ সালে ইংল্যান্ড সফরে সৌরভের নাম বিবেচিত হল। বলা হল, তিনি নাকি কোটার খেলোয়াড়। প্রথম টেস্টে ভারত হেরে গেছে, দ্বিতীয় টেস্ট ম্যাচে অনুষ্ঠিত হবে ক্রিকেটের মক্কা লর্ডস শহরে। চারটি বছর জীবন থেকে হারিয়ে গেছে। সমসাময়িক খেলোয়াড় শচীন ইতিমধ্যে প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন। সৌরভ বোধহয় সুযোগের অপেক্ষায় ছিলেন। লর্ডসের ২২ গজের মাঠটাকেই বেছে নিলেন নিজেকে প্রকাশ করার মঞ্চ হিসাবে। দুর্দান্ত সেঞ্চুরি করে স্তব্ধ করলেন সমালোচকদের মুখ। পরের টেস্টে আবার শতরান। এরপর থেকেই ভারতীয় ক্রিকেটে সৌরভের জয়যাত্রা শুরু। বিশ্বের প্রাক্তন ক্রিকেটার ও বর্তমানে ক্রীড়া ভাষ্যকার জিওফ বয়কট তাঁকে ডাকতেন প্রিন্স অব ক্যালকাটা নামে ।
টেস্ট ম্যাচের পাশাপাশি একদিনের ক্রিকেটেও সৌরভের আবির্ভাব যথেষ্ট সাড়া জাগাল। সৌরভ এগিয়ে গেলেন ঝড়ের গতিতে। একটির পর একটি সেঞ্চুরি করলেন। শচীনের সঙ্গে পার্টনারশিপকে করে তুললেন সকলের কাছে ঈর্ষণীয় । তখন শচীন ও সৌরভের নাম ক্রিকেট প্রেমিক মানুষের মুখে মুখে। শচীন এবং সৌরভ হয়ে উঠলেন পরস্পরের পরিপূরক। পাকিস্তানের মতো শক্তিশালী দলের বিরুদ্ধে টরেন্টোয় এই ইনিংস-এ ৫ উইকেট নিলেন মাত্র ১৬ রানে। ১৯৯৬ সালে তৃতীয় ম্যাচে সৌরভকে বাদ দেওয়া হয়েছিল। পরের বছর একই দেশের বিরুদ্ধে একই জায়গায় চারটি খেলায় ম্যান অব দ্যা ম্যাচ-এর সম্মান পেলেন। ১৯৯৯ বিশ্বকাপে সৌরভ মোট ৩৭৯ রান করেছেন।
অধিনায়ক হিসাবেও সৌরভের কৃতিত্ব যথেষ্ট ঈর্ষণীয়। ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারিয়ে সাহারা কাপ জিতলেন ১৯৯৯ সালে। ২০০০ সালে অধিনায়ক হয়ে শক্তিশালী দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারালেন ৩-২ ম্যাচে। টানা ১৬ টি টেস্ট জয়ের বিশ্বরেকর্ড করা অস্ট্রেলিয়াকে ২ ১ মার্জিনে পরাভূত করলেন। ২০০১ সালে জিম্বাবোয়ের মাটিতে টেস্ট জিতলেন। দীর্ঘ ১৫ বছর বাদে উপমহাদেশের বাইরে সৌরভের অধিনায়কত্বে ভারত সিরিজ জয়ের স্বাদ পেল ।
যদিও বারবার তাঁকে আচ্ছন্ন থাকতে হয়েছে শচীন নামের আশ্চর্য মিথ এর দ্বারা। যদিও নানা কুচক্র ক্রিয়াশীল থেকেছে সৌরভের বিরুদ্ধে, তা সত্ত্বেও কিন্তু তারা বিন্দুমাত্র দমাতে পারেনি বাংলার এই কুশলী অলরাউন্ডারটিকে। বেহালার গাঙ্গুলী পরিবারের সৌরভের সৌরভ তখন ছড়িয়ে পড়েছিল দেশ থেকে দেশান্তরে। শুধুমাত্র ব্যাটসম্যান বা বোলার নয়, একজন দক্ষ ক্যাপ্টেন হিসেবেও তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। গত কয়েক বছরে ভারত যে সফলতা পেয়েছে, তার মধ্যে প্রধানটি এসেছে টরেন্টো কাপে, সৌরভের অধিনায়কোচিত ব্যাটিং এবং ক্যাপটেনসির মাধ্যমে।
টনটনে বিশ্বকাপে শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে করা তাঁর চোখ ধাঁধানো ১৮২ রান একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচে একজন ভারতীয় ব্যাটসম্যানের সর্বোচ্চ রান। বোলিং- এও যথেষ্ট কৃতিত্ব দেখান সৌরভ। যখন মনে হয় বিপক্ষের ব্যাটিং গ্রানাইট পাথরের মত জমাট, হয়ে উঠেছে তখন চেঞ্জ বোলার হিসাবে নেমে তিনি তাঁর গোল্ডেন আর্মের সাহায্যে একটির পর একটি উইকেট নিয়ে নেন।
বর্তমানে সৌরভকে ধারা ভাষ্যকার ও প্রশাসকের ভূমিকায় ও দেখা যায়। তিনি দুরদর্শনে ‘দাদাগিরির' হোস্টের (অ্যাংকারিং) ভূমিকায় দেখা যেত ও বর্তমানে সি এ বি-এর প্রেসিডেন্ট পদে অধিষ্ঠিত আছেন। যখন ভারতের ক্রিকেট ইতিহাস রচিত হবে সৌরভকে বাদ দিয়ে কখনই ভারতের ক্রিকেট ইতিহাস লেখা সম্পূর্ণ হতে পারবে না ।