মাদার তেরেসা এর জীবনী
মাদার তেরেসা-প্রেম, শান্তি ও আশ্রয়ের প্রতীক একটি নিপীড়ন, শোষণ ও নিষ্ঠুরতার হাত থেকে মানুষকে মুক্তি দেবার জন্য যে সকল সাধু মহাত্মা অশেষ কষ্ট ভোগ করেছেন আজীবন, অকাতরে প্রাণ পর্যন্ত দিয়েছেন, মাদার তেরেসা তাদেরই শেষ উত্তরাধিকারী। নাম।
তৎকালীন যুগোস্লাভিয়ার দক্ষিণ অঞ্চলের একটি ছোট্ট গ্রাম স্কোপজে (Skopje)। এখানেই এক আলবেনিয় রোমান ক্যাথলিক কৃষক পরিবারে ১৯১০ খ্রি : ২৭ শে আগস্ট মাদারের জন্ম। তাঁর পিতার নাম নিকোলাস বোজাকসহিউ, পেশায় ছিলেন মুদি। তিনি মেয়ের নামকরণ করেছিলেন অ্যাগনেস গোনক্সহা বোজাকসহিউ (Agenes Gonxha Bojaxhiu )।
আলবেনিয়ার এই দরিদ্র দম্পতি কোনও দিন ভাবতে পারেননি তাঁদের অতি শান্ত কন্যাটি একদিন পৃথিবীর যাবতীয় দুঃখ মোচনের স্বপ্নকে রূপ দেবার জন্য নিজের জীবনকেই উৎসর্গ করবেন।
ছোট্ট মেয়েটি করুনাময় যিশু আর মাতা মেরির ছবির সামনে চোখবন্ধ করে নতমস্তকে দাঁড়িয়ে যে শক্তির প্রার্থনা করতেন তা ছিল তাঁদের অজানা। ঈশ্বরের কাছে এই নীরব প্রার্থনাই ছিল মাদারের যাবতীয় শক্তির উৎস।
পরবর্তী জীবনেও যতই কাজ থাক প্রার্থনার সময়টি তিনি প্রায় সামরিক নিয়মের কঠোরতায় রক্ষা করেছেন।
অ্যাগনেসরা ছিলেন দুইবোন ও এক ভাই। তাঁর একটা পা ছিল কৃশ। শারীরিক এই বিকৃতির জন্য একটি লজ্জার আবরণ তাঁকে ঘিরে থাকতো সবসময়
সাত বছর বয়সে অ্যাগনেস পিতৃহীন হন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত যুগোস্লাভিয়ায় তার মা অনেক কষ্টে লালন পালন করেন সন্তান কটিকে। মায়ের প্রেরণাতেই দরিদ্রের প্রতি দয়া ও ঈশ্বরের প্রতি ভক্তি বিশ্বাস লাভ করেছিলেন অ্যাগনেস। অল্প বয়স থেকেই ধর্মীয় কাজকর্মের প্রতি আকৃষ্ট হন তিনি।
স্কোপজের পাবলিক স্কুলে পড়বার সময়েই সোডালিটি সংঘের মিশনারিদের কাজকর্মের প্রতি অ্যাগনেসের মন আকৃষ্ট হয়।
সঙ্গের পত্রপত্রিকাগুলি নিয়মিত পড়তেন তিনি। ওই পত্রিকাতেই ভারতের নানা খবর প্রকাশিত হত। তাঁর নিজের কথায়, “ At the age of twelve I first knew I had a vocation to help the poor. I wanted to be a missionary.”
স্কোপজে পাবলিক স্কুলের ক্লাসে যুগোস্লাভিয়ার জেসুইটদের চিঠি পড়ে শোনানো হতো। ওই সব চিঠিতে কোলকাতার কথাও বিশেষভাবে থাকতো। সে সব শুনে শুনেই কলকাতার প্রতি একটা আকর্ষণ তৈরি হয়েছিল অ্যাগনেসের মনে।
খবর নিয়ে জানতে পারলেন আয়ারল্যান্ডের লরেটো সঙ্ঘ ভারতে কাজ করছে। লরেটো সঙ্ঘের প্রধান কার্যালয় ডাবলিনে। যোগাযোগ করলেন তিনি। তারপর মায়ের অনুমতি নিয়ে যোগ দিলেন লরেটো সঙ্ঘে। গেলেন আয়ারল্যান্ডের বাথার্নহামে। তখন তাঁর বয়স মাত্র
আঠারো বছর। সেই বছরেই, ১৯২৮ খ্রি : অ্যাগনেস জাহাজে ভেসে চলে এলেন কলকাতায়। যোগ দিলেন আইরিশ সন্ন্যাসিনীদের প্রতিষ্ঠান সিস্টারস অব লরেটোতে।
সেই প্রথম বাংলার মাটি তাঁকে বরণ করে নিল। সেই শুরুর দিন। থেকেই অ্যাগনেস মনে প্রাণে হয়ে গেলেন বাংলারই মানুষ । তখনো পর্যন্ত তিনি পুরো সন্ন্যাসিনী হন নি। শিক্ষানবিশী পর্ব শেষ করার জন্য তাঁকে পাঠিয়ে দেওয়া হল দার্জিলিঙে।
দুবছরের পাঠক্রম শেষ করে গ্রহণ করলেন সন্ন্যাসিনী ব্রত। সিস্টার অ্যাগনেস হয়ে ফিরে এলেন কলকাতায়। এন্টালি সেন্ট মেরিজ স্কুলের বাংলা বিভাগে শিক্ষয়িত্রী নিযুক্ত হলেন। তাঁর পড়াবার বিষয় ছিল ভূগোল ও ইতিহাস ।
কুড়ি বছর তিনি ওই স্কুলের শিক্ষয়িত্রী ছিলেন। ১৯৪২ খ্রিঃ হন ওই স্কুলের অধ্যক্ষা। স্কুলে শিক্ষকতার সময়েই নিকটস্থ মতিঝিল বস্তির বাসিন্দাদের দারিদ্র্য, শিশুদের কষ্ট তাকে গভীরভাবে বিচলিত করে।
সেটা ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কাল। মানুষের সৃষ্ট দুর্ভিক্ষে শহর কলকাতার তখন নাভিশ্বাস। দুমুঠো ভাতের আশায়, একবাটি ফ্যানের আশায় দলে দলে গ্রামের মানুষ ভিড় করছে কলকাতায়, অনাহারে কুখাদ্য খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে মারা যাচ্ছে।
সিস্টার অ্যাগনেস এই সময়েই শুরু করলেন তাঁর কাজ। অচিরেই তিনি বুঝতে পারলেন পেছনে বন্ধন রেখে দরিদ্র আর্তের সেবা হয় না। এখানকার অতি দীন ক্ষুধার্ত মানুষদের পাশে আশা-ভরসার ঝুলি নিয়ে দাঁড়াতে হলে তাকে চার দেওয়ালের গন্ডির নিশ্চিত জীবন থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।
১৯৪৬ খ্রি : ১০ই সেপ্টেম্বর দার্জিলিং যাওয়ার সময় এক অলৌকিক উপলব্ধি হল তাঁর। তিনি যেন ঈশ্বরের প্রত্যাদেশ শুনতে পেলেন।
এই উপলব্ধির কথা বলতে গিয়ে মাদার নিজেই বলেছেন, “... a call within a call...... The message was clear. I was to leave the convent and help the poor, while living among them."
গরিবের সেবা করতে হলে গরিব হয়ে তাদের মধ্যে থেকেই তা করতে হবে। ঈশ্বরের এই আদেশ লাভের দিনটিকে আমৃত্যু স্মরণ করতেন মাদার। তিনি বলতেন দ্য ডে অব ডিসিশন অনুপ্রেরণার দিন।
সিস্টার অ্যাগনেস থেকে মাদার তেরেসায় রূপান্তরিত হবার সেই ছিল সুত্রপাত। মাদার প্রতিষ্ঠিত মিশনারিজ অব চ্যারিটি এই দিনটিকে অনুপ্রেরণা দিবস হিসেবে পালন করে। সঙ্ঘ মনে করে ১০ই সেপ্টেম্বর ১৯৪৬ খ্রিঃ তাদের সঘের গোড়াপত্তন হয়।
মাদার সুপিরিয়রের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে অ্যাগনেস লোরেটোর কাজ ছেড়ে দিলেন। লোরেটো সন্ন্যাসিনীদের আলখাল্লা ছেড়ে তুলে নিলেন মোটা নীলপাড় শাড়ি ।
সেদিন তাঁর সম্বল বলতে ছিল পাঁচটি টাকা, একটি বাইবেল, ক্রস গাঁথা একটি জপের মালা। আর সঙ্গে ছিল অকল্পনীয় মনোবল ও ঈশ্বরে নির্ভরতা।
১৯৫০ খ্রি : একান্ত নিঃস্ব অবস্থায় শুরু করলেন তাঁর প্রথম সেবাব্রতের কাজ। স্থাপন করলেন তার মিশনারী অব চ্যারিটি।
এভাবেই কলকাতায় তিনি আত্মনিয়োগ করলেন মানুষ ও মানবতার সেবায়। মনপ্রাণ ঢেলে দিলেন নিপীড়িত দুই দরিদ্র অসহায় গণদেবতার সেবায়। তিলে তিলে গড়ে তুলতে লাগলেন তাঁর সেবা প্রতিষ্ঠান। দুঃখী দুঃস্থ আর্ত জর্জরিত মানুষকে তিনি একান্ত মায়ের স্নেহ-মমতায় বুকে তুলে নিতে লাগলেন।
মাত্র পাঁচ টাকা মূলধন নিয়ে তিনি যে মিশনারিজ অব চ্যারিটি প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তুলেছিলেন, তা আজ সারা বিশ্বে সম্প্রসারিত হয়েছে শত শাখা-প্রশাখায়। মানবতার সেবা ও শিক্ষা সম্প্রসারণের জন্য তিনি বহুদেশে বহু শিশু ভবন, মহিলা কর্মকেন্দ্র, ভ্রাম্যমাণ চিকিৎসা কেন্দ্র, খাদ্য ও বস্ত্র বিতরণ কেন্দ্র এবং কুষ্ঠাশ্রম ইত্যাদি স্থাপন করেছেন।
মাদার তেরেসা কুষ্ঠ রোগীদের জন্য গড়ে তোলেন একটি চিকিৎসা ও সেবাকেন্দ্র। এই মহীয়সী নারী বৃদ্ধ বয়সেও সেবাব্রতের কাজে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে দেশে অক্লান্তভাবে ঘুরে বেড়িয়েছেন। মাঝে মাঝে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন ও আবার সুস্থ হয়ে মানবতার সেবায় আত্মনিয়োগ করেন। মুমূর্ষু দুস্থ দরিদ্রকে বুকে জড়িয়ে ধরেন। মাতৃত্বের এমন দৃষ্টান্ত বিশ্বে বিরল।
মানুষকে ভালবাসার অতুলনীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন মাদার তেরেসা। গোটা বিশ্ব তা স্বীকার করেছে আনত মস্তকে, দুহাত ভরে পুরস্কার দিয়েছে তাঁকে।
১৯৬২ খ্রিঃ ভারত সরকার পদ্মশ্রী উপাধিতে ভূষিত করেছে। সে বছরই মাদারকে দেওয়া হয় ম্যাগসেসে পুরস্কার। সেবছরই ষষ্ঠ পোপ পলের হাত থেকে গ্রহণ করেন ২৩ তম পোপ জন শান্তি পুরস্কার। একই বছরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টনে তাকে দেওয়া হয় গুড সামারিটান পুরস্কার।
একমাস পরেই পান জন এফ কেনেডি আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অ্যাওয়ার্ড ফর ইন্টারন্যাশনাল আন্ডারস্ট্যান্ডিং পুরস্কার। আধ্যাত্মিকতা বিকাশের স্বীকৃতি হিসেবে ইংলন্ডের প্রিন্স ফিলিপ ১৯৭৩ খ্রিঃ মাদারের হাতে তুলে দেন টেম্পলটন অ্যাওয়ার্ড ফর
প্রগ্রেস ইন রিলিজিয়ন। ১৯৭৯ খ্রিঃ মাদারকে শান্তির জন্য দেওয়া হল নোবেল পুরস্কার। ১৯৮০ খ্রিঃ পেলেন ভারত সরকারের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মান ভারতরত্ন ।
প্রেম, করুণা, মায়া-মমতা, সেবা-শুশ্রুষার এক জীবন্ত প্রতিমা মাদার তেরেসা। দুস্থ পরিদ্র অসহায় অবহেলিত রোগজর্জরিত মানুষের ত্রাণকর্ত্রী, মানবমুক্তি ও মানবকল্যাণের মূর্ত প্রতীক মাদার তেরেসা ১৯৯৭ খ্রিঃ ৬ই সেপ্টেম্বর জীবনের সীমানা ছাড়িয়ে পৌঁছে গেলেন অমৃতলোকে।
প্রয়াত মাদার তেরেসাকে ৪ঠা সেপ্টেম্বর ২০১৬ "সম্ভ” উপাধিতে ভূষিত করেছেন রোমান ক্যাথলিক চার্চের পোপ ফ্রান্সিস।