মহাবিজ্ঞানী এরিস্টটল এর জীবনী
খ্রীষ্টপূর্ব ৩৮৪ অব্দে এথেন্স থেকে প্রায় দুইশত মাইল উত্তরে। মেসিডোনিয়ার অন্তর্গত স্টোগিরা নগরে মহামতি এরিস্টটল জন্মগ্রহণ করেন। প্রাচীন বিজ্ঞানী ও দার্শনিকদের মধ্যে বিশ্বে এরিস্টটলই সর্ব-অগ্রগণ্য। তাঁকে বিজ্ঞান, জ্যোতির্বিজ্ঞানের ও দর্শনের গুরুও বলা হয়।
এই মনীষীর পিতা ছিলেন আলেকজান্ডারের দাদা (পিতামহ), মেসিডোনিয়ার রাজা এরিমনটাসের বন্ধু ও চিকিৎসক।
শৈশবকাল থেকেই চিকিৎসাবিদ্যা চর্চার পরিবেশে মানুষ হওয়ায় এরিস্টটল পিতার মতো বিজ্ঞানমনস্ক হয়ে পড়েন। তবে সেই প্রাচীন যুগে বিজ্ঞান চর্চার মাধ্যম ছিলো কোনো যন্ত্রপাতি নয়—শুধু জ্ঞানী ও বিজ্ঞ মানুষের অসাধারণ মেধা ও পর্যবেক্ষণ শক্তির দক্ষতা। যে জন্য আধুনিক যুগের একজন গ্রীক বিশেষজ্ঞ এবং লেখক পেলার এরিস্টটল সম্পর্কে বলেছেন, তিনি ঘড়ি ছাড়া সময় নির্ণয় করতে, থার্মোমিটার ছাড়া আবহাওয়া পরীক্ষা করতে বাধ্য ছিলেন। কারণ যে সবের উপর আধুনিক বিজ্ঞানের ব্যবহারিক মতামত প্রতিষ্ঠিত তার কিছুই তো তখন আবিষ্কৃত হয়নি।
এজন্যে একটা দূরবীক্ষণ যন্ত্রের অভাবে এরিস্টটলের জ্যোতির্বিদ্যা -চর্চা হয়ে পড়েছে ছেলেমানুষী কল্পনা-প্রসূত। এক অণুবীক্ষণের অভাবে তাঁর জীববিদ্যা হয়ে পড়েছে লক্ষহীন আর বিপথগামী। বিভিন্ন দিকে তাঁর সময়কালে অতুলনীয় সাফল্য সত্ত্বেও গ্রীস শিল্প ও কারিগরী আবিষ্কারের ক্ষেত্রে অনেক পিছনে পড়ে ছিলো। সম্ভবত এ কারণেই এরিস্টটল কদাচিৎ পরীক্ষা নিরীক্ষার কথা বলেছেন নিরীক্ষার যন্ত্রপাতিই তো তখন আবিষ্কৃত হয়নি। বড় জোর তিনি -কারণ পরীক্ষা অবিরাম এবং সার্বিক পর্যবেক্ষণেরই শুধু ব্যবহার করতে পারতেন।তবুও এসব সীমাবদ্ধতা সত্বেও এরিস্টটল অক্লান্ত চেষ্টা, পরিশ্রম এবং নিজস্ব অসাধারণ মেধার সঙ্গে তাঁর অন্যান্য সহযোগীদের সাহায্যে যে-সব বিপুল তথ্যরাজির সংগ্রহ রেখে গেছেন মাত্র ৬২ বছরের জীবনকালে, তাতে বিস্ময়ে মানুষকে হতবাক হতে হয়। তিনি বিভিন্ন বিষয়ের উপর লিখে গেছেন অজস্র গ্রন্থ। কেউ বলেন চারশোটি, কেউ বলেন হাজার খানেক। তার রচনার একটা অংশ মাত্র সংরক্ষিত হয়েছে—তবুও তা-ই একটা লাইব্রেরীর সমতুল্য।
প্রথমেই রয়েছে তাঁর 'লজিক' বা যুক্তিবিদ্যা সম্বন্ধীয় রচনাবলী। এরপর রয়েছে তাঁর বিজ্ঞান সম্বন্ধীয় রচনাবলী। যেমন পদার্থবিদ্যা, জ্যোতির্বিদ্যা, আবহাওয়াবিদ্যা, বিকাশ ও অবক্ষয়, প্রাকৃতিক ইতিহাস, আত্মা সম্বন্ধে, জীবজন্তুর অঙ্গ, জীবজন্তুর গতিবিধি এবং জীব প্রজনন। তৃতীয়ত আছে তাঁর সৌন্দর্য-তত্ত্ব সম্বন্ধীয় রচনাবলী। যেমন- 'অলঙ্কার' আর 'কাব্যশাস্ত্র'। চতুর্থত আছে তাঁর বিভিন্ন দর্শনতত্ত্বমূলক রচনাবলী। যেমন— নীতিবিদ্যা, রাজনীতি, এবং পরাবিদ্যা।
যদিও অবশ্য দেখা যায় তাঁর কালের অন্যান্য দার্শনিকদের বিবেচনায় আনলে তাঁর রচনাসমগ্রে ভুলভ্রান্তি যথেষ্ট আছে, বৈজ্ঞানিক তথ্যাদিতেও অনেক ভ্রমাত্মক সিদ্ধান্ত তিনি টেনেছেন, কিন্তু তবুও তাঁর রচনাবলীতে জ্ঞান ও মতের যে অভূতপূর্ব সমন্বয় সাধন ঘটেছে, তা আধুনিককালের বিচারেও অতুলনীয় ঐশ্বর্যে সমৃদ্ধ।
এরিস্টটলের জ্ঞানের রাজ্যে বিশ্ববিজয় একদিক দিয়ে চিন্তায় আনলে তার এককালীন ছাত্র মহামতি আলেকজান্ডারের চেয়েও বেশি গৌরবের। যদিও এরিস্টটল তার গুরু প্লেটোর তুলনায় বহুমুখি প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন বেশি, একই সঙ্গে দার্শনিক ও বৈজ্ঞানিক রচনাবলীর এক বিশাল ভান্ডার বিশ্বকে দান করেছেন। তবে এরিস্টটল তাঁর গবেষণাকর্মে তাঁর ছাত্র আলেকজান্ডারের কাছ থেকে আর্থিক সহ বহুদিক দিয়ে অনেক সাহায্য সহযোগিতা পেয়েছিলেন—যা প্লেটো পাননি।
এরিস্টটল খ্রীষ্টপূর্ব ৩২২ সনে ৬২ বছর বয়সে মৃত্যুমুখে পতিত হন