চৈতন্যজীবনী :- 1486 খ্রিস্টাব্দে ফাল্গুনী পূর্ণিমার দিনে শ্রীচৈতন্য নবদ্বীপে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা পণ্ডিত জগন্নাথ মিশ্র, মাতা শচীদেবী। জগন্নাথের আদি বাস ছিল শ্রীহট্টে। শ্রীচৈতন্যের অগ্রজের নাম বিশ্বরূপ। তাঁর বালা নাম বিশ্বজ্ঞা, ডাকনাম নিমাই। গায়ের রং গৌরবর্ণ ছিল বলে তাকে গৌরাঙ্গ বা গোরা বলেই ডাকত। বড় ভাই অল্প বয়সেই সন্ন্যাসী হয়েছিলেন বলে, পিতা গৌরাঙ্গকে প্রথমে টোলে না পাঠালেও পরে তাঁর দুরস্তুপনায় অতিষ্ঠ হয়ে গঙ্গাদাস পণ্ডিতের টোলে পাঠান।
সেযুগে নবদ্বীপ ছিল বাংলাদেশের সর্বপ্রধান বিদ্যাকেজ ও নব্যন্যায়ের পীঠস্থান। স্বল্পদিনের মধ্যেই নিমাই নানা শাস্ত্রে অসাধারণ জ্ঞান অর্জন করে পণ্ডিত সমাজে অগ্রগণ্য বলে খ্যাতি লাভ করেন। পিতার দেহত্যাগের পর নিজেই টোল খুলে শিক্ষকতা শুরু করেন। লক্ষ্মীপ্রিয়াকে বিয়ে করার কিছুদিন বাদেই তিনি পূর্ববঙ্গে ভ্রমণে যান। বেশ কিছুদিন সেখানে নানা স্থান পরিভ্রমণ শেষে নবদ্বীপ ফিরে আসেন। এদিকে সর্পাঘাতে স্ত্রীর মৃত্যুর পরে মাতাকে সান্ত্বনা দেবার জন্য বিষ্ণুপ্রিয়াকে বিয়ে করেন।
ষোল বৎসর বয়সে গয়াধামে পিতার পিণ্ডদান করতে গিয়ে সন্ন্যাসী ঈশ্বরপুরীর কাছে নিমাই 'গোপাল মন্ত্রে দীক্ষা গ্রহণ করেন। সেদিন থেকে তাঁর জীবনে দেখা দেয় ভক্তিরসের প্লাবনধারা। শুরু হয় জীবনের নব অধ্যায়।
নবদ্বীপে ফিরে নবরূপে নিমাই আত্মপ্রকাশ করেন। পাণ্ডিত্যের অহংকার দূরে নিক্ষেপ করে খণ্ড-বিচ্ছিন্ন সমাজজীবনে ঐক্য ও প্রেম আনবার জন্য হরিসংকীর্তন শুরু করেন। শ্রীবাস পণ্ডিতের ঘরে অহোরাত্র কীর্তন চলতে থাকে। এ ব্যাপারে তাঁর প্রধান সহায়ক নিত্যানন্দ ও হরিদাস। কাজীর নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে, নানা প্রতিকূল অবস্থাকে উন্নঙ্ঘন করে তাঁর নগর সংকীর্তন নবদ্বীপধামকে ভগবৎ প্রেমে মাতোয়ারা করে।
24 বছর বয়সে কাটোয়ায় কেশবভারতীর কাছ থেকে নিমাই সন্ন্যাসধর্ম গ্রহণ করেন। এরপর তাঁর নাম হয় “শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য”—সংক্ষেপে 'শ্রীচৈতন্য'। এরপর কিছুদিন শান্তিপুরে অদ্বৈত আচার্যের গৃহে থেকে তিনি পদব্রজে পুরী যান, সেখান থেকেই প্রথমে দাক্ষিণাত্য, মহারাষ্ট্র ও গুজরাট ভ্রমণ করেন। দ্বিতীয়বার শান্তিপুর, গৌর, রামকেলি। এই রামকেলিতে অবস্থানকালেই হুসেন শাহের দুই মন্ত্রী 'সাকর মল্লিক' (সনাতন) ও 'দবীর খান' (রূপ) শ্রীচৈতন্যের সঙ্গে মিলিত হয়ে সন্ন্যাস গ্রহণ করেন। তৃতীয়বার তিনি ঝাড়খণ্ড, কাশী, মথুরা, প্রয়াগ, বৃন্দাবন ঘুরে আসেন। তীর্থ ভ্রমণে তাঁর মোট ছয় বছর লেগেছিল। জীবনের শেষ আঠারো বছর শ্রীচৈতন্য পুরীধামেই ছিলেন। জীবনের শেষ কয় বছর তিনি প্রায় দিব্যোন্মাদ অবস্থায় কাটান। প্রেমধর্মে সমগ্র দেশকে প্লাবিত করে 1533 খ্রিস্টাব্দে পুরীতেই তাঁর তিরোভাব ঘটে। এই ভিরোভাবের ব্যাপারটি আজও রহস্যপূর্ণ রয়েছে। তবে প্রচলিত ধারণা অনুসারে নানা মত পাওয়া যায়। (1) দিব্যোন্মাদ অবস্থায় শ্রীচৈতন্য সমুদ্রের বুকে লীন হয়েছেন। (2) নগ্নপদে দিব্যোম্মাদ অবস্থায় নগর সংকীর্তনকালে পায়ে আঘাত পান, সেই আঘাতজনিত কারণে দেহান্ত ঘটে। তৃতীয় কারণ হিসাবে পুরীর পাণ্ডাদের ষড়যন্ত্রের কথাও অস্বীকার করা যায় না। তবু শ্রীচৈতন্যের তিরোভাবের ব্যাপারটি আজও রহস্যাবৃত আছে।
বাংলা সমাজ-সাহিত্য-সংস্কৃতি ও ধর্মীয় জীবনে শ্রীচৈতন্যের প্রভাব
প্রাক্-চৈতন্যযুগের অন্ধকারময় যুগ ও তুর্কী আক্রমণে বিধ্বস্ত জাতীয়-জীবনে নূতন প্রাণ সঞ্চারের নানা উপায় — অনুবাদ শাখা ও মঙ্গলকাব্য ধারার আলোচনায় জানা গেছে। কিন্তু চৈতন্য আবির্ভাবের পর তাঁর প্রাণপূর্ণ প্রেমসিদ্ধ আহ্বানে বাঙালি চিন্তা-চেতনার জগতে যে সাড়া জেগেছিল, তার ফলে সমাজজীবনে দেখা দেয় ভরা জোয়ার। বাংলার প্রিয়মাণ মঞ্জুর জীবনে জেগে ওঠে নূতন সুর ও ছন্দ, দেখা দেয় তীব্র গতি। বাংলার সমাজ ও সাহিত্যের ক্ষেত্রে চৈতন্যদেবের বহুমুখী প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। স্মার্ত হিন্দু সমাজের বৌদ্ধিক অহংকার ও বৃহত্তর সমাজ থেকে দূরত্ববোধ, দূর হয়। চৈতন্যদেবের ধর্মীয় উদারতা নিম্নমার্গের মানুষকে উৎসাহিত ও উদ্বেলিত করে। 'আজি-চণ্ডাল' একই মঞ্চে এসে দাঁড়ায়। জাতিভেদ, ধনী-দরিদ্র্যের সীমানা ভেঙে পারস্পরিক বিশ্বাসের ও ঐক্যের ভিত তৈরি হয়।
অদ্বৈত আচার্য, রূপ ও সনাতন, রায় রামানন্দ প্রমুখ পণ্ডিতগণ যেমন চৈতন্যদেবের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন, তেমনি রাজা প্রতাপ রুদ্র, পঞ্চকোটের হরিনারায়ণ রাজ, সপ্তগ্রামের ধণাঢ্য বণিক উচ্চারণ দত্ত প্রমুখ ব্যক্তি তাঁর অনুগামী হন। বাংলার সমাজে ধর্ম-সংস্কার প্রেম-ভক্তির পথ ধরে দ্রুত অগ্রসর হয়। ধর্মীয় জীবনে সংহতিবোধ দেখা দেয়। চৈতন্যদেবের জীবনদর্শনে—
“চণ্ডাল চণ্ডাল নহে যদি কৃষ্ণ বোলে।
বিপ্ৰ বিপ্ৰ নহে যদি অসৎ পথে চলে।।”
এই দর্শনের আলোকেই এক সর্বধর্ম সমন্বয়ী ভাবনা উজ্জ্বলরূপে উদ্ভাসিত হয়। কাজীর সংকীর্তন নিষেধের আদেশকে অমান্য করে চৈতন্যদেব অহিংস আন্দোলনের গোড়া পত্তন করেন। সমাজজীবনকে কলুষমুক্ত করে পবিত্র আদর্শ, মানবমুখী জীবন-যাপনের পথ তিনিই দেখান। হিন্দুধর্মের জাতিভেদ প্রথাকে অস্বীকার করে, এমনকী অন্য ধর্মাবলম্বীদের প্রতি মানবতাবাদী দৃষ্টি নিয়ে হিন্দু-মুসলমানের বিভেদ দূর করতে পদক্ষেপ নেন। প্রমাণস্বরূপ ভক্ত হরিদাসের কথা বলা যায়। তাঁর ধর্ম-আন্দোলনে ইসলামি ভাব-ভাবনা ও সুফি-সাধনরীতির কিছু কিছু সূত্রও মিশে যায়। অর্থাৎ ধর্ম সমন্বয়ের শক্ত ভিতের ওপর চৈতন্যদেব সমগ্র সমাজকে দাঁড় করাতে সক্ষম হয়েছেন। সামন্ততান্ত্রিক সমাজের শোষণ-বঞ্চনা, ধর্মের নানা আচার-বিচার-ব্যভিচার থেকে মুক্ত, সমন্বয়ী, সুস্থ, আত্মশক্তিতে জাগ্রত, ভক্তিপ্লাবনে মুখরিত, মানব প্রেমের বার্তা তিনি ঘরে ঘরে পৌঁছে দেন। ড. অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে চৈতন্য শুধু একজন ব্যক্তি নন, একটি যুগের প্রতিনিধি—শুধু একটি যুগের প্রতিনিধি নন, সর্ব যুগের প্রেমভক্তি, ত্যাগ-তিতিক্ষার একমাত্র প্রতীক বলে ইতিহাসে স্বীকৃতি লাভ করেছেন।” মাত্র 48 বছর জীবনকালে চৈতন্যদেব ধর্ম সম্প্রদায়, সাহিত্য, সমাজ ও সংস্কৃতির ওপর যে প্রভাব বিস্তার করেছিলেন বিশ্বইতিহাসে তা সুদুর্লভ।
চৈতন্যদেবের প্রভাবে বাংলা সাহিত্যজগতে স্বর্ণযুগের সম্ভাবনা দেখা দেয়। তাঁর জীবনের কর্মকাণ্ডকে কেন্দ্র করেই জীবনী-সাহিত্য রচনার শুরু। বৈষ্ণব পদাবলিতে তাঁর প্রেমমগ্ন ভাবতন্ময় জীবনকেন্দ্রিক গৌরাঙ্গ পদ রচিত হ'লো। গৌড়ীয় বৈষ্ণব দর্শনের আলোয় মধ্যযুগের বিভিন্ন সাহিত্য শাখায় শ্লথতা, স্থূলতা, অবিন্যস্ততাইত্যাদি বর্জন করে স্রষ্টাগণ রচনাভঙ্গি, প্রকাশরীতি ও জীবনবোধের ক্ষেত্রে নিয়ে আসেন সংযম-শাসিত, পরিণত রসোত্তীর্ণ বিচিত্র সৃষ্টি সম্ভার। এক কথায় বাংলা সাহিত্য জগতে নব-প্রাণের সঞ্চার হয়।
“চৈতন্যযুগ”—পঞ্চদশ শতাব্দীর সমাপ্তি থেকে সপ্তদশ শতাব্দীর আরম্ভ পর্যন্ত চিহ্নিত। এই সময়সীমায় চৈতন্যদেবের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাবে বাংলার বুকে নব-সংস্কৃতি গড়ে ওঠে। দলবদ্ধ ভাবে একই সুরে, ছন্দে, নৃত্যে—অনন্ত প্রেমভাবনা ও মানবতাবাদের গভীরে ডুবে যাবার পথ দেখান চৈতন্যদেব। প্রেম, ভক্তি, করুণা, মৈত্রীর মধ্য দিয়ে মনুষ্যত্ববোধের চরম বিকাশের সাংস্কৃতিক পাথেয় জুগিয়েছেন চৈতন্যদেব। তাঁর সংস্কৃতি যথার্থই প্রগতিধর্মী, মানবতাবাদী, স্বচ্ছ সংস্কৃতির উজ্জ্বলবর্তিকা ।
See translate in any