বক্সারের যুদ্ধের কারণ :
রাজনৈতিক কারণ :-------
মুঙ্গেরে রাজধানী স্থানান্তর : সিংহাসনে আরোহণের পর মির কাশিম স্বাধীনভাবে রাজত্ব করার জন্য রাজধানী স্থানান্তরিত করেন মুঙ্গেরে। বাংলার রাজধানী মুর্শিদাবাদ ছিল ইংরেজ প্রভাবিত। তাই তিনি রাজধানী স্থানান্তরের পরিকল্পনা করেছিলেন।
বৈধ ফরমান লাভ : মির কাশিম ইংরেজদের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে অবৈধভাবে বাংলার সিংহাসন লাভ করেন। তিনি নিজেকে বৈধ নবাব হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার জন্য বার্ষিক ২৬ লক্ষ টাকা রাজস্ব প্রদানের অঙ্গীকার করে মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলমের ফরমান নিয়েছিলেন। এই ব্যবস্থা ইংরেজরা মেনে নিতে পারেনি।
সামরিক কারণ :--------
ইউরোপীয় রণকৌশল গ্রহণ : নবাব মির কাশিম চিরাচরিত রণকৌশলের পরিবর্তে উন্নত ইউরোপীয় ধাঁচে সেনাবাহিনীকে মজবুত করতে চেয়েছিলেন। এর জন্য তিনি আর্মেনীয় গ্রেগরিকে প্রধান সেনাপতি, ফরাসি সমরুকে এবং আর্মেনীয় মার্কারকে সহসেনাপতি পদে নিযুক্ত করেছিলেন।
আগ্নেয়াস্ত্র নির্মাণের কারখানা প্রতিষ্ঠা : মির কাশিম উপলব্ধি করেছিলেন তার সেনাবাহিনীর অন্যতম দুর্বলতার কারণ— উন্নত আগ্নেয়াস্ত্রের অভাব। এই অসুবিধা দূর করার জন্য তিনি মুঙ্গের কামান, বন্দুক, গোলাবারুদের কারখানা গড়ে তুলেছিলেন। বলা বাহুল্য মির কাশিমের এইসব কার্যকলাপ ইংরেজদের সহ্য হয়নি।
অর্থনৈতিক কারণ :--------
আর্থিক সমস্যা : 1. চুক্তিমতো নবাব বর্ধমান, মেদিনীপুর ও চট্টগ্রাম জেলার রাজস্ব ইংরেজদের দিয়ে নিয়ন্ত্রণমুক্ত হন|
2. এরপর তিনি ১৩% ভূমিরাজস্ব এবং সেস ও আবওয়াব বৃদ্ধি করেন, 3. হিসাব পরীক্ষা করে অর্থ তছরূপকারী রাজস্বকর্মীদের জরিমানা করেন, 4. আলিবর্দি ও মির জাফরের পরিবারের সঞ্চিত অর্থ বাজেয়াপ্ত করেন,
5. জগৎ শেঠ পরিবারের কাছ থেকে প্রচুর অর্থ আদায় করেন। এর ফলে নবাবের আর্থিক সচ্ছলতা এলেও ইংরেজদের সঙ্গে তার সম্পর্ক খারাপ হয়।
দেশীয় বণিকদের শুল্ক প্রত্যাহার : ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ১৭১৭ খ্রিস্টাব্দে মুঘল সম্রাট ফাররুখশিয়রের কাছ থেকে বিনাশুল্কে বাণিজ্যের অধিকার লাভ করে। কিন্তু কোম্পানির কর্মচারীরা ব্যক্তিগত ব্যাবসাতে এই ফরমানের অপব্যবহার করতে থাকে। এতে নবাব ও দেশীয় বণিকগণ ক্ষতিগ্রস্ত হন। এমতাবস্থায় নবাব দেশীয় বণিকদের শুল্ক প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেন। ফলে ইংরেজদের সঙ্গে তার বিরোধ চরম আকার ধারণ করে। এই সমস্ত ঘটনার মিলিত পরিণামেই ১৭৬৪ খ্রিস্টাব্দে বক্সারের যুদ্ধহয়।
বক্সারের যুদ্ধের গুরুত্ব :
ভূমিকা: বক্সারের যুদ্ধ হয়েছিল ১৭৬৪ খ্রিস্টাব্দে বক্সার নামক জায়গায়। এই যুদ্ধ হয়েছিল বাংলার নবাব মির কাশিম, অযোধ্যার নবাব সুজা উদ-দৌলা ও মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলমের মিলিত বাহিনীর সঙ্গে ইংরেজদের। ভারতের ইতিহাসে বক্সারের যুদ্ধের গুরুত্ব উপলব্ধি করে ঐতিহাসিক বিপানচন্দ্র বলেছেন, 'বক্সারের যুদ্ধ সর্বাধিক তাৎপর্যপূর্ণ'।
বক্সারের যুদ্ধের গুরুত্ব :-------
চূড়ান্ত বিজয় : পলাশির যুদ্ধে ভারতে ইংরেজদের ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত হলেও বক্সারের যুদ্ধে তা সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। পলাশির যুদ্ধে ইংরেজ কোম্পানি কূটনীতি ও বিশ্বাসঘাতকতার আশ্রয় নিয়ে অনভিজ্ঞ নবাবকে পরাজিত করে। কিন্তু বক্সারের যুদ্ধে পরাজিত হন দিল্লির সম্রাটসহ প্রাদেশিক দুই নবাব। ঐতিহাসিক ভিনসেন্ট স্মিথ বলেন, ‘পলাশির যুদ্ধ ছিল কয়েকটি কামানের লড়াই, কিন্তু বক্সারের যুদ্ধ ছিল চূড়ান্ত বিজয়'।
ভারতে ইংরেজদের আধিপত্যের সূচনা : বক্সারের যুদ্ধে কেবলমাত্র বাংলার নবাব মির কাশিমই নন, তার সঙ্গে পরাজিত হন অযোধ্যার নবাব ও দিল্লির মুঘল বাদশাহ। এর ফলে ভারতবর্ষের উপর ইংরেজদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার সূচনা হয়। ‘নামসর্বস্ব’মুঘল সম্রাট ইংরেজ কোম্পানির বৃত্তিভোগীতে পরিণত হন।
দেওয়ানি লাভ : বক্সারের যুদ্ধের পর ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলমের কাছ থেকে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার দেওয়ানি অধিকার লাভ করে। এর ফলে কোম্পানির বৈধ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়।
বাংলায় কোম্পানির প্রতিষ্ঠা লাভ: বক্সারের যুদ্ধে জয়লাভের পর ইংরেজ কোম্পানি মির জাফরকে পুতুল নবাব হিসেবে সিংহাসনে বসায়। তার মৃত্যুর পর তার নাবালক পুত্র নজম উদ-দৌলাকে সিংহাসনে বসিয়ে ইংরেজরা সমস্ত সামরিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতা। অধিকার করে।
মূল্যায়ন : এককথায় বলা যায়, পলাশির যুদ্ধের ফলে ইংরেজরা যে ক্ষমতালাভ করেছিল তা পরিপূর্ণতা লাভ করে বক্সারের যুদ্ধের পর। এই যুদ্ধের পর বাংলাদেশে স্বাধীন নবাবির অবসান ঘটে। বস্তুত ইংরেজদের প্রকৃত সার্বভৌম ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত হয়।