Translate

আধুনিক পশ্চিমবঙ্গের রূপকার ডাঃ বিধানচন্দ্র রায় এর জীবনী (Biography of Dr. Bidhanchandra Roy)

                                               ডাঃ বিধানচন্দ্র রায় এর জীবনী


পশ্চিমবঙ্গের এক মফস্বল অঞ্চলের এক মহিলা দীর্ঘদিন থেকে মাথার যন্ত্রণায় ভুগছেন। দেশের নামী দামী বহু চিকিৎসকের পরামর্শ ও ব্যবস্থা অনুযায়ী ওষুধপত্র খেয়েছেন, টোটকা চিকিৎসাও করিয়েছেন, কিন্তু কিছুতেই তার মাথার যন্ত্রণা কমেনি। দীর্ঘদিন থেকে ভুগে ভুগে হতাশ হয়ে পড়েছিলেন মহিলা।

সর্বশেষ চেষ্টা হিসাবে ভদ্রমহিলার স্বামী তাকে নিয়ে এলেন কলকাতায় এক চিকিৎসকের কাছে। দেশজোড়া নামডাক সেই চিকিৎসকের। সাক্ষাৎ ধন্বন্তরী বলে পরিচিত তিনি। একমাত্র এই চিকিৎসককেই রুগী দেখানো বাকি ছিল।

প্রতিদিন সকালের দিকে কিছু সময় বিনা পারিশ্রমিকে রুগী দেখতেন সেই চিকিৎসক। নিজের বাসভবনেরই একটি ঘরে তিনি বসতেন। ঘরের প্রান্তে তাঁর বসার চেয়ার। দরজা দিয়ে ঢুকে রুগীকে হেঁটে ডাক্তারবাবুর সামনে গিয়ে বসতে হয়।

ঘরে ঢোকা আর হেঁটে গিয়ে আসনে বসার সময়ের মধ্যে ডাক্তারবাবু তার রোগীকে পর্যবেক্ষণ করে রোগনির্ণয় করে নিতেন। এমনই ছিল তাঁর দক্ষতা। প্রায় সময়ই রুগীকে মুখ ফুটে তার রোগের কষ্টের কথা বলতে হত না। ডাক্তারবাবু রুগীর দেহের লক্ষণ, চলাফেরা ও চেহারা দেখেই রোগ নির্ণয় করে ফেলতেন এবং রুগীকে তার রোগ উপসর্গের কথা শুনিয়ে দিতেন। পরে সেই মত ব্যবস্থাপত্র লিখে দিতেন।

প্রতিদিনই শহরের এবং বহু দূর দূর অঞ্চল থেকে বহু দুরারোগ্য রোগে অসুস্থ মানুষ ভিড় করত ডাক্তারবাবুর বাসভবনে। সেই মহিলাকেও তাঁর স্বামী নিয়ে এলেন একদিন। তিনি যথাসময়ে ঘরে। ঢুকে ধীর পায়ে হেঁটে গিয়ে ডাক্তারবাবুর সামনের আসনে বসলেন। এতক্ষণ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মহিলাকে লক্ষ করছিলেন ডাক্তারবাবু। মহিলা আসন নিতেই তিনি মৃদু হেসে বললেন, চব্বিশঘন্টা মাথার যন্ত্রণায় কষ্ট পাচ্ছেন বলে মনে হচ্ছে। আলোর দিকে তাকাতেও কষ্ট হয় ?

ডাক্তারবাবুর কথা শুনে ভদ্রমহিলার যন্ত্রণাক্লিষ্ট মুখের রেখায় আশ্চর্য একটা আরামের হাসি যেন ছোঁয়া দিয়ে গেল। তিনি বিহ্বলভাবে আরো কিছু কষ্টের কথা সকাতরে ডাক্তারবাবুকে জানালেন।

ডাক্তারবাবু বললেন, কোন ওষুধপত্রের দরকার হবে না, এখন থেকে যেই সিঁদুরটা আপনি ব্যবহার করেন সেটা আর করবেন না। বাজারের ভাল কোন সিঁদুর ব্যবহার করবেন। কিছুদিন দেখুন, এরপর আমাকে জানাবেন। বলাবাহুল্য দূষিত সিঁদুরের বিক্রিয়া থেকেই সেই মহিলা স্থায়ী মাথাযন্ত্রণার শিকার হয়েছিলেন এবং ডাক্তারবাবুর পরামর্শ মত সিঁদুরের ব্র্যান্ড বদল করবার পর থেকেই তিনি আরোগ্য লাভ করেন।

এই ধম্মস্তরী চিকিৎসকটির নাম ডাঃ বিধানচন্দ্র রায়। যিনি পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে তাঁর কর্মকৃতিত্বের জন্য স্মরণীয় হয়ে রয়েছেন। দীর্ঘকায় চেহারার এই মানুষটি তাঁর সময়ে ভারতের সর্বশ্রেষ্ঠ চিকিৎসকরূপে দেশেবিদেশে খ্যাতিলাভ করেছিলেন। তাঁর আর এক পরিচয় ছিল, তিনি ছিলেন আধুনিক পশ্চিমবঙ্গের রূপকার। স্বাধীনতা লাভের পর তাঁর চেষ্টাতেই পশ্চিমবঙ্গে বিভিন্নমুখী উন্নয়নের সূত্রপাত হয় এবং বলা চলে তারই পরিকল্পিত পথ ধরেই পশ্চিমবঙ্গের অগ্রগতি এখনো অব্যাহত রয়েছে।

ডাঃ বিধানচন্দ্র রায়ের পরিবারের আদি নিবাস ছিল চব্বিশ পরগনা জেলার টাকী শ্রীপুরে। তাঁর জন্ম পিতার কর্মস্থল বিহারের পাটনা শহরের বাঁকিপুরে ১৮৮২ খ্রিঃ ১লা জুলাই। তাঁর পিতা প্রকাশচন্দ্র রায় ছিলেন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। মাতার নাম অঘোরকামিনী দেবী। ১৯০১ খ্রিঃ বি.এ পাশ করবার পর বিধানচন্দ্র কলকাতায় চলে আসেন এবং এখানেই স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। 

চিকিৎসাবিদ্যা অধ্যয়ন করবার জন্য তিনি কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হন। ১৯০৬ খ্রিঃ এল.এম.এস. এবং ১৯০৮ খ্রিঃ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এম. ভি. উপাধি লাভ করেন। এরপর প্রাদেশিক মেডিক্যাল সার্ভিসে যোগ দিয়ে চিকিৎসক হিসেবে বিভিন্ন প্রদেশে ঘোরেন।

চিকিৎসা বিজ্ঞানে উচ্চতর শিক্ষালাভের জন্য বিধানচন্দ্ৰ ১৯০৯ খ্রিঃ বিলেত যাত্রা করেন। সেইকালে দেশে সুচিকিৎসার অভাবে বহু মানুষ নানাবিধ দুরারোগ্য রোগে ভুগে প্রাণ হারাত। দেশে শ্বেতাঙ্গ চিকিৎসকদেরই দাপট। কিন্তু কজন আর তাদের কাছে পৌঁছতে পারে।

চিকিৎসা ক্ষেত্রের এই দুরবস্থা বিধানচন্দ্রকে পীড়িত করত। তাই চিকিৎসাশাস্ত্রে পরিপূর্ণ জ্ঞান লাভের উদ্দেশে তিনি বিলেত যাত্রা করেন ১৯০৯ খ্রিঃ। সেখানে দুই বছর থেকে এম. আর-সি. পি. এবং এম. আর. সি. এস ও পরে এফ. আর. সি. এস উপাধি অর্জন করেন।

বর্তমানে যেটি নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ, সেসময় তার নাম ছিল ক্যাম্বেল মেডিক্যাল স্কুল। বিলেত থেকে ফিরে এসে বিধানচন্দ্র সেখানে চিকিৎসকরূপে যোগদান করেন। সেই সঙ্গে নিজেও চিকিৎসা ব্যবসা শুরু করেন। অল্প সময়ের মধ্যেই সুচিকিৎসক রূপে তাঁর খ্যাতি চারদিকে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। সেই সঙ্গে দেশের সমাজ জীবনের সঙ্গেও তাঁর যোগাযোগ তৈরি হতে থাকে।

১৯১৬ খ্রিঃ বিধানচন্দ্র কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেনেটের সদস্য নির্বাচিত হন। দুই বছর পরে ১৯১৮ খ্রিঃ তিনি ক্যাম্বেলের সরকারী চাকরী ছেড়ে দেন। যোগদান করেন কারমাইকেল মেডিক্যাল কলেজে, মেডিসিনের অধ্যাপক পদে। বর্তমান আর.জি.কর মেডিক্যাল কলেজের নামই সেকালে ছিল কারমাইকেল মেডিক্যাল কলেজ। এখানে কর্মরত অবস্থাতেই তিনি রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন।

ভারতবর্ষে স্বাধীনতার আন্দোলন সেই সময় উত্তাল হয়ে উঠেছে। মত বিরোধের প্রশ্নে দেশবন্ধু ততদিনে কংগ্রেসের বাইরে স্বরাজদল প্রতিষ্ঠা করেছেন। তাঁর সঙ্গে রয়েছেন মতিলাল নেহরু প্রমুখ দেশবিশ্রুত নেতৃবৃন্দ।

বাংলা তথা ভারতের অবিসংবাদিত জননেতা দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের প্রভাবে বিধানচন্দ্র রাজনীতিতে যোগ দেন ১৯২৩ খ্রিঃ। তাঁর স্বরাজ দলের হয়ে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে বিধানচন্দ্র বাংলার ব্যবস্থাপক সভার সদস্য নির্বাচিত হন।

এরপর ১৯২৮ খ্রিঃ কলকাতা কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক এবং ১৯৩১-৩২ খ্রিঃ কলকাতা কর্পোরেশনের মেয়র হলেন।

বিধানচন্দ্র ছিলেন দেশপ্রেমিক, সত্যনিষ্ঠ ও নির্ভীক। ১৯৩১ খ্রিঃ আইন অমান্য আন্দোলনের সময় তিনি অকুতোভয়ে কলকাতা কর্পোরেশনে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন। এই সময়ে বোম্বাই থেকে কলকাতা ফেরার পথে ওয়ার্দা স্টেশনে বিধানচন্দ্র গ্রেপ্তার হন।

সকল কর্মব্যস্ততার মধ্যেও চিকিৎসক হিসেবে দেশের জনগণের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করতে তিনি কখনো শৈথিল্য করেন নি। চিকিৎসক হিসেবে সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতার কথা তিনি একদিনের জন্যও বিস্মৃত হননি। ফলে চিকিৎসক হিসেবে কেবল দেশেই নয় আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও তিনি খ্যাতি ও স্বীকৃতি লাভ করেছিলেন। ১৯৩৫ খ্রিঃ বিধানচন্দ্র রয়্যাল সোসাইটি অব ট্রপিক্যাল মেডিসিন, অ্যান্ড হাইজিন এবং ১৯৪০ খ্রিঃ আমেরিকান সোসাইটি চেস্ট ফিজিসিয়ানের ফেলো নির্বাচিত হন। ১৯৩৭ খ্রিঃ তিনি বাংলার পার্লামেন্টারী কমিটির সভাপতি হন এবং কংগ্রেসের নির্বাচন পরিচালনা করেন। দেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে এভাবে ক্রমশই বিধানচন্দ্রের প্রভাব ও গুরুত্ব বৃদ্ধি পেতে থাকে।

১৯৪২ খ্রিঃ বিধানচন্দ্র কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিযুক্ত হন। ১৯৪৪ খ্রিঃ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ডি. এসসি. উপাধিতে ভূষিত করে।

১৯৪৭ খ্রিঃ বিধানচন্দ্র কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় নির্বাচন কেন্দ্র থেকে কংগ্রেস মনোনীত প্রার্থীরূপে আইন সভার সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৪৮ খ্রিঃ ২৩শে জানুয়ারী পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচিত হন। এই পর্যায় থেকে বিধানচন্দ্রের কর্মময় নতুন জীবনের সূত্রপাত হয় । প্রখ্যাত চিকিৎসক ও রাজনীতিজ্ঞ বিধানচন্দ্র হলেন পশ্চিমবঙ্গের  কর্ণধার—তার গঠনমূলক কর্মধারা বহুবিচিত্র পথে বিকশিত হবার সুযোগ লাভ করল।

স্বাধীনতার পরে আদি বঙ্গদেশের এক তৃতীয়াংশ ভূমিভাগ নিয়ে গঠিত হয়েছিল ক্ষতবিক্ষত সমস্যা জর্জরিত পশ্চিমবঙ্গ। এই সময়ে কেন্দ্রীয় সরকারের পরিকল্পনা ছিল বিধানচন্দ্রকে উত্তরপ্রদেশের রাজ্যপাল করে পাঠানো। তার জন্যই এই পদটি নির্দিষ্ট হয়েছিল।

সেই সময়ে ডক্টর প্রমচন্দ্র ঘোষ ছিলেন পশ্চিমবঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী। তিনি ছিলেন অত্যন্ত সৎ ও সত্যনিষ্ঠ রাজনীতিজ্ঞ। কিন্তু নানাবিধ চক্রান্তের শিকার হয়ে তাকে মুখ্যমন্ত্রীত্বের পদ ছাড়তে হয়েছিল।

পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর সেই শূন্য আসনে অত্যন্ত আকস্মিকভাবেই বিধানচন্দ্র আসীন হলেন এবং আমৃত্যু এই গুরু দায়িত্ব পালন করে গেছেন।

প্রথম থেকেই তিনি যোগ্যতার পরিচয় দিয়েছেন। বিধানচন্দ্রই প্রথম স্বাধীন ভারতকে প্রথম নির্বাচন কমিশনারকে উপহার দিয়েছিলেন। তাঁর নাম সুকুমার সেন। শিল্প ও যোগাযোগ ব্যবস্থার ওপরই দেশের অর্থনৈতিক উন্নতি নির্ভরশীল। 

বিধানচন্দ্র তাই রাজ্যের এই দুই দিকে প্রথম থেকেই বিশেষভাবে নজর দিলেন। শিল্পের পুনরুজ্জীবন ঘটাবার জন্য তিনি নানাভাবে উদ্যোগ গ্রহণ করলেন। এই রাজ্যের চটকলগুলির প্রয়োজনীয় কাচামাল অর্থাৎ পাট আসত প্রধানতঃ পূর্ব বাংলা থেকে।

দেশবিভাগের ফলে পূর্ববাংলা হয়ে গেল ভিন্ন দেশ। ফলে রাজ্যের চটশিল্পে দেখা দিয়েছিল চরম সংকটজনক অবস্থা। এই অবস্থার মোকাবিলার জন্য বিধানচন্দ্র পশ্চিমবঙ্গে ব্যাপকভাবে পাট চাষের বন্দোবস্ত করলেন।

এছাড়া বিধান নগর উপনগরী, কল্যাণী উপনগরী, রাষ্ট্রীয় পরিবহন, হরিণঘাটা দুগ্ধ প্রকল্প, বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় যেমন কল্যাণী, বর্ধমান, উত্তরবঙ্গ ও বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়, বেন্ডেল তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র এবং দামোদর ভ্যালী কর্পোরেশনের বিভিন্ন প্রকল্প এই সকল কিছু প্রতিষ্ঠার মূলেই ছিলেন কর্মবীর বিধানচন্দ্র রায়। এক কথায় বলা চলে স্বাধীনতা লাভের পর পশ্চিমবঙ্গের রূপায়নে  বিধান রায়ের গঠনমূলক প্রতিভা ও ব্যক্তিত্ব সর্বতোভাবে প্রভাব বিস্তার করে। বিভিন্ন ভারি শিল্প প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে তিনি পশ্চিমবঙ্গে অর্থনৈতিক উন্নতির ভিত্তি স্থাপন করে গেছেন।

ব্যবসায়ী হিসেবেও বিধান রায় তাঁর প্রতিভার ছাপ রেখে গেছেন। শিলং হাইড্রো ইলেকট্রিক কোম্পানীর অন্যতম ডিরেক্টর ছিলেন তিনি। জাহাজ, বিমান ও ইন্সিওরেন্স ব্যবসায়ের সঙ্গে যোগ ছিল তাঁর।

১৯৪৮ খ্রিঃ থেকে ১৯৬২ খ্রিঃ পর্যন্ত দীর্ঘ চোদ্দ বছর একটানা পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর পদে আসীন ছিলেন বিধানচন্দ্র। ১৯৬১ খ্রিঃ ভারত সরকার তাঁকে ভারতরত্ন উপাধি দিয়ে সম্মানিত করে। ১৯৬২ খ্রিঃ ১লা জুলাই কর্মরত অবস্থাতেই কলকাতার রাজভবনে আধুনিক পশ্চিমবঙ্গের রূপকার কর্মবীর ও দেশের সর্বশ্রেষ্ঠ চিকিৎসক বিধানচন্দ্র রায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।