লৌহমানবী ভারত রত্ন ইন্দিরা গান্ধীর জীবনী
বিশ্বের কয়েকজন মহিলা প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী অন্যতম। ভারতের প্রধান মন্ত্রী থাকা কালে তিনি লৌহ মানবী বলে খ্যাত হন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে ইন্দিরাগান্ধীর সক্রীয় সমর্থন ও সহযোগিতার কথা ঐ দেশের জনগণ কোনো দিন ভুলবে না।
ভারতের প্রথম মহিলা প্রধান মন্ত্রী প্রিয়দর্শিনী ইন্দিরা গান্ধী। ১৯১৭ খ্রিঃ ১৯ নভেম্বর উত্তর প্রদেশের এলাহাবাদে এক ঐতিহ্যবাহী সমৃদ্ধিশালী রাজনৈতিক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ইন্দিরা ভারতবর্ষের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু এবং তাঁর স্ত্রী কমলা নেহরুর একমাত্র কন্যা। তিনি পশ্চিমবঙ্গের শান্তিনিকেতন, জেনেভা এবং অক্সফোর্ডে শিক্ষালাভ করেন।
জাতীয় চেতনায় উদ্বুদ্ধ পারিবারিক পরিবেশে লালিত হয়ে এবং পিতা জওহরলালের উৎসাহে বাল্যবয়স থেকে ইন্দিরার মনে স্বদেশ প্রীতির বীজ রোপিত হয়। ১২ বছর বয়সে ১৯৩০ খ্রিঃ তিনি 'চরকা সংঘ' গঠন করেন। পরে প্রায় ৬০০০ ছেলেমেয়ে নিয়ে জাতীয় কংগ্রেসের কিশোর বাহিনী 'বানর সেনা' সৃষ্টি করেন।
১৯৩৮ খ্রিঃ ইন্দিরা কংগ্রেসের সদস্য হন। ফিরোজ গান্ধীর সঙ্গে বিবাহ হয় ১৯৪২ খ্রিঃ। বিবাহের কিছুদিন পরে 'অন্তর্ঘাতমূলক' কাজ করার অভিযোগে তিনি ১৩ মাসের জন্য কারাদন্ডে দন্ডিত হন।
১৯৫৫ খ্রিঃ ইন্দিরা কংগ্রেসের কার্যকরী সমিতির সদস্যা এবং ১৯৫৯-৬০ খ্রিঃ জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি পদে বৃত হন। ১৯৬৪ খ্রিঃ তিনি রাজ্যসভার সদস্য নির্বাচিত হন।
জওহরলালের মৃত্যুর পরে লালবাহাদুর শাস্ত্রী প্রধান মন্ত্রী হন। ১৯৬৪-৬৬ খ্রিঃ শাস্ত্রীজির মন্ত্রিসভায় তথ্য ও বেতার দপ্তরের মন্ত্রী হন ইন্দিরা। লালবাহাদুর শাস্ত্রীর মৃত্যুর পরে কংগ্রেসের কার্যকরী সমিতির অধিকাংশ সদস্যের ইচ্ছায় তিনি প্রধানমন্ত্রী পদে নির্বাচিত হন।
১৯৬৯ খ্রিঃ রাষ্ট্রপতি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে কংগ্রেস কার্যকরী সমিতির সঙ্গে তাঁর মনোমালিন্য সৃষ্টি হয়। তিনি দলীয় প্রার্থী নীলম সঞ্জীব রেড্ডিকে সমর্থন না করে দলীয় সদস্যদের বিবেক অনুযায়ী। নির্দল প্রার্থী ভি. ভি. গিরিকে ভোট দিতে অনুরোধ করেন।
প্রধানত তারই আগ্রহ এবং চেষ্টায় ভি. ভি. গিরি জয়যুক্ত হন। এই ঘটনা এবং মোরারজী দেশাইয়ের অর্থ দপ্তর স্বয়ং গ্রহণ এবং দেশাইয়ের মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগকে কেন্দ্র করে জাতীয় কংগ্রেস সংগঠন কংগ্রেস বা আদি কংগ্রেস এবং নব কংগ্রেস—এই দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। শ্রীমতী গান্ধী নব কংগ্রেসের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন এবং ১৯৭১ খ্রিঃ লোকসভা নির্বাচনে দলকে জয়ী করতে সমর্থ হন।
জনপ্রতিনিধিত্ব আইনের (Representation of People Act) ১২৩ (৭) ধারা মতে নির্বাচনে অন্যায়ভাবে জয়ের অপরাধে এলাহাবাদ হাইকোর্ট তার নির্বাচনকে অবৈধ বলে ঘোষণা করলেও সুপ্রীম কোর্ট তা বৈধ বলে ঘোষণা করেন।
অতঃপর শ্রীমতী গান্ধী ধৈর্য ও নিষ্ঠার সঙ্গে সরকারের প্রধান রূপে কাজ চালাতে থাকেন।
১৯৭৫ খ্রিঃ ২৬শে জুন তিনি সারা দেশে ‘জরুরী অবস্থা' জারী করেন। ১৯৭৭ খ্রিঃ লোকসভার নির্বাচনে তিনি পরাজিত হন। তাঁর দলও শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়। ফলে কেন্দ্রে ৩০ বছরের কংগ্রেসী শাসনের ছেদ ঘটে।
মোরারজী দেশাইয়ের নেতৃত্বে কেন্দ্রে জনতা সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৭৮ খ্রিঃ ১লা জানুয়ারী কংগ্রেস দল পুনরায় দুটি ভাগে বিভক্ত হয়। শ্রীমতী গান্ধী কংগ্রেসের বৃহৎ গোষ্টীর নেতৃত্বে অবিচল থাকেন এবং তাঁর একান্ত অনুরাগীগণ এবং কনিষ্ঠপুত্র সঞ্জয় গান্ধী তাঁকে চরম বিপদের দিনেও সর্বতোভাবে সাহায্য করতে থাকেন। তাঁদের আপ্রাণ চেষ্টা ও শ্রীমতী গান্ধীর প্রতি আনুকূল্য, স্বয়ং ইন্দিরা গান্ধীর মনোবল, দৃঢ়তা ও জনতা সরকারের তীব্র অন্তর্দ্বন্দ্বের ফলে ১৯৮০ খ্রি : লোকসভা নির্বাচনে শ্রীমতী গান্ধী স্বয়ং এবং তাঁর দল জয়ী হয়ে কেন্দ্রে ফিরে আসেন।
এর পরবর্তী ইতিহাস হল, শ্রীমতী গান্ধী আমৃত্যু প্রধানমন্ত্রীরূপেই কেন্দ্রীয় সরকারের প্রধান হয়ে কাজ করে গেছেন। এছাড়া তিনি তাঁর দলেরও সভাপতির পদ অলঙ্কৃত করেছেন। শ্রীমতী গান্ধীর প্রধানমন্ত্রীত্বের প্রথম ১০ বছরের উল্লেখযোগ্য কর্মকাণ্ডগুলির মধ্যে রয়েছে ব্যাঙ্ক এবং কয়লাখনি রাষ্ট্রীয়করণ, রাজন্য ভাতা বিলোপ, পাকিস্তানের সঙ্গে সীমান্ত সংঘর্ষে উপযুক্ত ব্যবস্থা
গ্রহণ, বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে সাহায্য দান, ইন্দো-সোভিয়েত চুক্তি, বিশদফা কর্মসূচী ৰূপায়ণের মাধ্যমে ভূমি সংস্কার, ভূমিহীন কৃষককে জমি দান এবং সেচ ও বিদ্যুৎ ব্যবস্থার উন্নতিকরণ।
শ্রীমতী গান্ধীর দ্বিতীয় দফা প্রধানমন্ত্রীত্বের কয়েক বছরের উল্লেখযোগ্য কাজের মধ্যে আছে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি বিধান ছাড়াও ১৯৮২ খ্রিঃ দিল্লীতে নবম এশিয়াডের সফল অনুষ্ঠান।
১৯৮১ খ্রিঃ কনিষ্ঠপুত্র সঞ্জয় গান্ধীর অকালমৃত্যু শ্রীমতী গান্ধীর জীবনে একটি বেদনাদায়ক ঘটনা। এই ঘটনার পরে তাঁর জ্যেষ্ঠপুত্র রাজীব গান্ধী শ্রীমতী গান্ধীকে সর্বপ্রকার সাহায্য করার কাজে এগিয়ে আসেন। শ্রীমতী গান্ধী ১৯৬৫ খ্রিঃ ইতালীয় 'ইসাবেলা পুরস্কার' এবং ১৯৭২ খ্রিঃ ভারতরত্ন উপাধি লাভ করেন। শান্তিনিকেতন থেকে দেশিকোত্তম উপাধিতেও তাকে ভূষিত করা হয়।
এছাড়াও তিনি দেশ ও বিদেশের বহু সম্মানজনক পদ ও উপাধি লাভ করেন। ১৯৮৪ খ্রিঃ ৩১শে অক্টোবর শ্রীমতী গান্ধী তাঁর সরকারী বাসভবনের প্রাঙ্গণেই দুজন উগ্রপন্থী শিখ দেহরক্ষী বিয়ান্ত সিং ও সতবস্তু সিং-এর গুলিতে নিহত হন। তাঁর এই আকস্মিক হত্যাকাণ্ডের পরেই জ্যেষ্ঠপুত্র রাজীব গান্ধী ভারতের প্রধানমন্ত্রীরূপে শপথ গ্রহণ করেন।
জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের সভানেত্রীরূপে জীবনের শেষভাগে শ্রীমতী গান্ধী বিশ্বের অন্যতম বরেণ্য নেত্রীর মর্যাদা ও স্বীকৃতি লাভ করেন। ইন্দিরা গান্ধী একজন দৃঢ়চেতা ও সুদক্ষ রাষ্ট্রনায়ক হিসাবে ভারতের ইতিহাসে অমর হয়ে থাকবেন।