জওহরলাল নেহরুর জীবনী
ইন্দিরা গান্ধীর পিতা, রাজীব গান্ধীর পিতামহ পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু ১৯৪৭ সনে ভারতের স্বাধীনতা লাভের পর থেকে ১৯৬৪ সালে মৃত্যু পর্যন্ত ভারতের প্রধানমন্ত্রী পদে আসীন ছিলেন। দীর্ঘ সতেরো বছর তিনি নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী হিসাবে ভারত পরিচালনার মুখ্য দায়িত্বে ছিলেন। তিনি মোট পাঁচবার ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হন। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে তিনি নেতৃত্ব দেন।
প্রখ্যাত ভারতীয় রাজনীতিবিদ এবং স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর জন্ম এলাহাবাদে, ১৮৯৮ খ্রিঃ ১৪ই নভেম্বর। তাঁর পিতা মতিলাল নেহরু, মাতা স্বরূপরানী।
মতিলাল নেহরু ছিলেন এলাহাবাদ হাইকোর্টের প্রখ্যাত আইনজীবী। ভারতের রাজনীতিতেও তিনি সক্রিয়ভাবে অংশ গ্রহণ করেছিলেন। স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগ দেবার ফলে বহুবার তাঁকে কারাদণ্ড ভোগ করতে হয়েছিল। মতিলাল নিজে জাতীয়তাবোধে প্রাণিত হলেও তাঁর পরিবারের পরিবেশ ছিল বিদেশানুগত।
এই আবহাওয়াতেই ধনীর বিলাস ও আদরের লালিত হয়েছিলেন জওহরলাল। তাঁর বাল্যের শিক্ষালাভ হয়েছিল ইংরাজ টিউটরের কাছে।
১৯০৫ খ্রিঃ জওহরলালকে বিলেত পাঠানো হল। সেখানে হ্যারোল, ট্রিনিটি কলেজ, কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় এবং সর্বশেষে লন্ডন স্কুল অব ইকনমিক্স-এ সর্বমোট সাত বছর অধ্যয়ন করেন। রসায়ন, ভূতত্ত্ব, পদার্থবিদ্যা নিয়ে পড়তে পড়তে তিনি সহসা উদ্ভিদবিদ্যা নিয়ে পড়া আরম্ভ করেন। পরে লন্ডন থেকে ১৯২২ খ্রিঃ দেশে ফিরলেন ব্যারিষ্টার হয়ে। এলাহাবাদে আইন ব্যবসায়ে কিছুকাল লিপ্ত থাকার সময়ে দিল্লির ময়দাকল মালিকের কন্যা কমলার সঙ্গে জওহরলালের বিবাহ হয়। ১৯১৭ খ্রিঃ তাদের কন্যা ইন্দিরার জন্ম হয়। ১৯২৫ খ্রিঃ এই সম্পতি এক পুত্রসন্তান লাভ করেন, কিন্তু দ্বিতীয় দিনেই তার মৃত্যু হয়।
১৯২২ সালে জওহরলাল নেহরু এলাহাবাদ পৌরসভার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। আইন ব্যবসা ছাড়াও পাশাপাশি তিনি পারিবারিক ঐতিহ্য অনুযায়ী রাজনীতিতেও পরিপক্কতা অর্জন করতে থাকেন।
১৯১৬ সালে বিয়ের পর তিনি রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে ওঠেন এবং তাঁর রাজনৈতিক গুরু এবং পরবর্তীকালে ভারতের জাতির পিতা মহাত্মা গান্ধীর সংস্পর্শে আসেন। তিনি ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে সবসময় সর্বাবস্থায় গান্ধীজীর সঙ্গে সহযোগিতা করেন।
বৃটিশ সরকারের নীতির বিরোধিতা করায় এবং স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্ব দান করায় জওহরলাল নেহরু গান্ধীর মতো বহুবার কারারুদ্ধ হন এবং সর্বমোট প্রায় ১৭ বছর জেল খাটেন। জেলে বসেই তিনি কয়েকটি গ্রন্থ রচনা করেন। যেগুলো পরে বিখ্যাত হয়েছিলো।
তিনি শুধু ভারতেই নয়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশেও পন্ডিত ও জ্ঞানী ব্যক্তি হিসাবে সুপরিচিত ছিলেন। তাঁর বইগুলোর মধ্যে আছে 'ডিসকভারি অব ইন্ডিয়া', 'নিম্পসেস অব ওয়ার্লড হিস্ট্রী' এবং 'অটোবায়োগ্রাফী'।
তিনি জেলে বসে নানা বিষয়ে কন্যা ইন্দিরা গান্ধিকে অনেক চিঠি লেখেন। সেগুলো নিয়ে পরে একটা সংকলন-গ্রন্থও প্রকাশিত হয় । তাঁর আত্মজীবনীর একটা অংশ স্কুলপাঠ্যও হয়েছিলো। নাম ছিলো My childhood..
জওহরলাল নেহরুর সভাপতিত্বেই অনুষ্ঠিত এক সভায় ১৯২৯ সালে ভারতীয় কংগ্রেস দল স্বাধীনতার পক্ষে সর্বাত্মক রায় দেয়। ১৯৩৭ সালে অনুষ্ঠিত প্রাদেশিক নির্বাচনে কংগ্রেস দলের বিজয়ের প্রধান স্থপতি ছিলেন জওহরলাল নেহরু।
১৯৪৭ সালের ১৫ই আগষ্ট ভারত স্বাধীনতা লাভ করলে জওহরলাল নেহরু প্রথম দেশের প্রধানমন্ত্রী মনোনীত হন। এরপর ১৯৬২ সাল পর্যন্ত অনুষ্ঠিত সকল নির্বাচনেই তার সমর্থিত কংগ্রেস দল জয়লাভ করে এবং তিনি প্রধানমন্ত্রী পদে বহাল থাকেন আজীবন। জওহরলাল নেহরু যদিও আজীবন রাজনীতিতে গান্ধীর শিষ্য ছিলেন, কিন্তু ভারতের অর্থনৈতিক উন্নয়ন পরিকল্পনায় দু'জনের মধ্যে বেশ মতপার্থক্য ছিলো।
গান্ধী ছিলেন পল্লীনির্ভর অর্থনীতির পক্ষে, কিন্তু নেহরু পাশ্চাত্যের মতো শিল্পে উন্নত করে আধুনিক ভারত গড়ার পক্ষপাতি ছিলেন। ভারত স্বাধীন হওয়ার কয়েক মাস পরে মহাত্মা গান্ধী আততায়ীর হাতে নিহত হলে তাদের এই মতপার্থক্য জটিল রূপ নিতে পারেনি।
বিশ্বরাজনীতিতে নেহরু সব সময় মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করে গেছেন। তিনি জোট নিরপেক্ষ রাজনীতির পক্ষ অবলম্বন করেন। ১৯৬১ সালে মিশরের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট কর্নেল নাসের, ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট সুকর্ণ এবং যুগোশ্লাভিয়ার প্রেসিডেন্ট মার্শাল টিটোর সঙ্গে একযোগে কাজ করে জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন গড়ে তোলেন। বাংলাদেশ জোটনিরপেক্ষ দেশসমূহের অন্তর্ভুক্ত।
জওহরলাল নেহরু শিশুদের খুব ভালোবাসতেন। এইজন্য তাঁর জন্মদিন ১৪ই নভেম্বরকে ভারতে 'শিশুদিবস' হিসাবে পালিত হয়। জওহরলাল নেহরুর কোনো পুত্রসন্তান ছিলো না। একমাত্র মেয়ে ইন্দিরা গান্ধীকে তিনি ভারতের সুযোগ্য ভাবী নেত্রী হিসাবে গড়ে তোলেন। তাঁর মৃত্যুর কয়েক বছর পর ইন্দিরা গান্ধীও ভারতের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন।
১৯৬৪ সালের ২৭শে মে ৭৫ বছর বয়সে ভারতের এই মহান নেতা জওহরলাল নেহরু মৃত্যুবরণ করেন।
রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক জীবনের নানা ব্যস্ততা সত্ত্বেও জওহরলালের সাহিত্যপ্রান হৃদয়টি নানা রচনায় নিয়োজিত হয়েছিল।
Soviet Russia (১৯২৮ খ্রিঃ), কন্যা ইন্দিরাকে লেখা Letters from a Father to his Daughter (১৯২৪ খ্রিঃ), Glimpses of World History (১৯৩৪ খ্রিঃ), China, Spain and the War (১৯৪০ খ্রিঃ) The Discovery of India (১৯৪৬ খ্রিঃ) প্রভৃতি গ্রন্থে জওহরলালের সাহিত্য প্রতিভার পরিচয় পাওয়া যায়।
পরবর্তীকালে তাঁর আত্মজীবনী ও Discovery of India গ্রন্থের বঙ্গানুবাদ হয়। তার ভাষণাবলীর সংকলন Speeches চারখন্ডে প্রকাশিত হয় (১৯৪৬-৬৪)।