Translate

ভারতের জাতির জনক মহাত্মা গান্ধীর এর জীবনী (The biography of Mahatma Gandhi, the father of the Indian nation)

                              ভারতের জাতির জনক মহাত্মা গান্ধীর এর জীবনী   


ভারতের জাতির পিতা মহাত্মা গান্ধী তাঁর সারাটা জীবন ভারতের স্বাধীনতার জন্য লড়াই করে গেছেন। তিনি ছিলেন অহিংসবাদী আন্দোলনের নেতা। সশস্ত্র সংগ্রাম তিনি পছন্দ করতেন না। তাঁরই নেতৃত্বে ভারতে আস্তে আস্তে স্বাধীনতা আন্দোলন দানা বেঁধে ওঠে এবং শেষ পর্যন্ত ১৯৪৭ সালে ইংরেজরা ভারত ছাড়তে বাধ্য হয়। ভারত ১৯৪৭ সালের ১৫ই আগস্ট স্বাধীনতা অর্জন করে।

ভারতের কাথিয়াবাড় প্রদেশের পোরবন্দর নামক স্থানে এক প্রাচীন বেনিয়া পরিবারে ১৮৬৯ খ্রিঃ ২রা অক্টোবর মোহনদাস করমচাদ গান্ধী জন্মগ্রহণ করেন। মোহনদাসের পূর্বপুরুষগণ বংশানুক্রমে কাথিয়াবাড় প্রদেশের পোরবন্দর নামক স্থানের দেওয়ান ছিলেন।

গান্ধীজির বাবার নাম করমচাঁদ। তাঁর ডাকনাম ছিল কাবা গান্ধী।

গুজরাটের সামাজিক নিয়ম হল, ছেলের নামকরণের সময় বাবার নামও তার নামের সঙ্গে জুড়ে দিতে হয়। এই নিয়ম অনুসারেই করমচাদের ছেলে মোহনদাসের নামের সঙ্গে তাঁর বাবার নাম জুড়ে নাম রাখা হয়েছিল মোহনদাস করমচাঁ গান্ধী। গান্ধীজি ছিলেন তাঁর বাবার সর্বকনিষ্ঠ পুত্র।

গান্ধীজির মাতার নাম পুত্তলীবাঈ। তিনি ছিলেন পরম নিষ্ঠাবতী মহিলা। পুজো আর সূর্য দর্শন না করে তিনি জল গ্রহণ করতেন না । বাল্য ও শৈশবের শিক্ষা কাথিয়াবাড়ে সমাপ্ত করেন মোহনদাস । এরপর বিলাতে গিয়ে ব্যারিস্টারি অধ্যয়ন করেন। পরে দেশে ফিরে এসে বোম্বাই হাইকোর্টে আইনব্যবসা আরম্ভ করেন।

গান্ধীজি সত্য ও সাহসের মন্ত্র পেয়েছিলেন তাঁর বাবার কাছ থেকে। মায়ের কাছ থেকে পেয়েছিলেন উপবাস ও কঠোর ব্রত পালনের শিক্ষা।

শৈশবকাল থেকেই মহাত্মা গান্ধী মিথ্যা কথা বলা, চুরি করা ইত্যাদিকে পাপকর্ম বলে মনে করতেন। এই কারণেই তিনি সত্যাশ্রয়ী হয়ে উঠেছিলেন।

মাত্র তেরো বছর পার হতেই তাকে বিয়ে দেওয়া হয় কস্তুরি বাঈ নামে এক সমবয়সী কিশোরীর সঙ্গে। ষোলো বছর বয়সে মহাত্মা গান্ধী প্রথম সন্তানের পিতা হন। সেইসাথে আপন পিতাকে হারান।

১৮ বছর বয়সে তিনি ম্যাট্রিক পাস করেন। উচ্চশিক্ষার জন্য বড়ভাই তাকে বিলেতে পাঠাতে চাইলেন ব্যারিস্টারী পড়ার জন্য। তখনকার দিনে কু-সংস্কারাচ্ছন্ন ভারতীয় হিন্দু সমাজে সমুদ্র পাড়ি দেওয়া ছিলো ঘোরতর পাপের কাজ। এই জন্য রাজকোটের অনেক সমাজপতি বড়ভাইকে এবং তাদের পরিবারকে সমাজচ্যুত করার হুমকি দিলেন। কিন্তু গান্ধী নিজে ব্যারিস্টারী পড়ার জন্য ছিলেন খুবই আগ্রহী । তাই মা পুতলি বাঈ কিছুটা গররাজী হলেও ছেলের মঙ্গল প্রত্যাশায় তাকে বিলেতে যেতে অনুমতি দিলেন।

১৮৮৮ সালের ৪ঠা সেপ্টেম্বর মহাত্মা গান্ধী বিলাতগামী জাহাজে চড়ে বসলেন । ১৮৯১ সালে মহাত্মা গান্ধী ব্যারিস্টারী পাস করে দেশে ফিরে এলেন। এসে শুনলেন মা মারা গেছেন। কিছুদিন পরে তিনি আইন ব্যবসা শুরু করলেন। কিন্তু তিনি অনেকটা লাজুক প্রকৃতির ছিলেন প্রথম দিকে আইন-ব্যবসায়ে তেমন জুত করতে পারলেন না।

১৮৯৩ খ্রিঃ দক্ষিণ আফ্রিকায় বসবাসকারী ভারতীয়দের একটি জটিল মামলার প্রয়োজনে তিনি নেটাল যাত্রা করেন। পরে সেখান থেকে ট্রান্সভাল যাত্রা করেন।

১৮৯৪ খ্রিঃ মোহনদাস মুষ্টিমেয় ভারতীয়দের নিয়ে নেটাল ইণ্ডিয়ান কংগ্রেস প্রতিষ্ঠা করেন। এই সময় নেটাল সরকার এশিয়াটিক এক্সকুশন অ্যাক্ট অর্থাৎ এশিয়াবাসী বিতাড়ন নামক একটি আইন পাস করেন। মোহনদাস এই আইনের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে প্রবাসী ভারতীয়দের ধন্যবাদভাজন হন।

নেটালে ও ট্রান্সভালে ভারতীয়দের দুরবস্থার বিষয় সাধারণকে এবং সরকারকে জানাতে ১৮৯৫ খ্রিঃ মোহনদাস ভারতে আসেন। 

তার ফলে দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণ বৈষম্যবাদী শেতাঙ্গরা তাঁর প্রতি অত্যন্ত রুষ্ট হন। সেখান থেকেই রাজনীতিতে প্রথম হাতেখড়ি হয়। তাঁর এবং পরবর্তীতে ভারতে ফিরে এসে তিনি সক্রিয়ভাবে রাজনীতি শুরু করেন। দেশমুক্তির নেতৃত্ব তুলে নেন নিজ স্কন্ধে। তিনি কংগ্রেসে যোগ দেন।

বৃটিশদের অপশাসন ও অত্যাচার-নির্যাতনের বিরুদ্ধে ১৯২০ সালের সেপ্টেম্বের মাসের কলকাতায় কংগ্রেসের বিশেষ অধিবেশনে গান্ধীজীর অসহযোগ আন্দোলন এবং একই সঙ্গে ভারতের স্বাধীনতা লাভের প্রস্তাব গৃহীত হয়। আন্দোলন ক্রমশঃ প্রবল হয়ে উঠতে থাকে। মহাত্মা গান্ধী ১৯৪২

সালে বৃটিশদের বিরুদ্ধে 'ভারত ছাড়ো' আন্দোলন গড়ে তোলেন তিনি কারারুদ্ধও হন বহুবার।

এদিকে মুসলিমদের নেতা মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকার জন্য ভারত ভাগ করে পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠনের দাবিতে সোচ্চার হয়ে ওঠেন। ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হলে বৃটিশরা ভারতের স্বাধীনতা দেবার অঙ্গীকার করে।

১৯৪৭ খ্রিঃ ১৫ই আগস্ট ভারত দেশভাগের মূল্য দিয়ে স্বাধীনতা অর্জন করে। সেই বছরেই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির জন্য গান্ধীজির নোয়াখালি সফর ভারত ইতিহাসের এক উল্লেখযোগ্য ঘটনা। পাকিস্তান স্বাধীনতা লাভ করে একদিন আগে ১৪ই আগস্ট ১৯৪৭। খ্রিঃ ৩০শে জানুয়ারী দিল্লিতে এক প্রার্থনা সভায় গান্ধীজি এক আততায়ীর হাতে নিহত হন।

বিশ্বের শ্রেষ্ঠ নাট্যকার ও বিশ্ববিখ্যাত মনীষী জর্জ বার্নার্ডশ গান্ধীজীর এই মর্মান্তিক হত্যাকান্ডে শোক প্রকাশ করে মন্তব্য করেন—“খুব ভালো মানুষ হওয়াটাও একটা বিপজ্জনক ব্যাপার।” গান্ধীজির জীবন দর্শন ও ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে তাঁর উল্লেখযোগ্য অবদানের জন্য তিনি জাতির জনক রূপে স্বীকৃতি লাভ করেছেন।

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ তাঁকে মহাত্মা নামে ডাকতেন। কারণ, সত্য, প্রেম, ত্যাগ, সেবা ও অহিংসাকেই জীবনের মূলমন্ত্র মেনে নিয়ে সারাটা জীবনই খুব সহজ ও সরল জীবন যাপন করেছেন। আচার     

আচরণে নির্ভীকতায় ও ব্যক্তিত্ব প্রকাশে তিনি 'জনগণের বাপুজী' হলেও ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের একজন সার্থক কর্ণধার। কিশোর কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য মহাত্মাজির প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানিয়ে লিখেছে —

  “চল্লিশ কোটি জনতার জানি আমিও যে একজন, 

 হঠাৎ ঘোষণা শুনেছি; আমার জীবন শুভক্ষণ 

এসেছে, তখনি মুছে গেছে ভীরু চিন্তার হিজিবিজি।

 রক্তে বেজেছে উৎসব, আজ হাত ধরো গান্ধীজি।

 এখানে আমরা লড়েছি, মরেছি, করেছি অঙ্গীকার, 

এ মৃতদেহের বাধা ঠেলে হব অজেয় রাজ্যে পার।" 

হাত্মা গান্ধীর জন্মের সার্ধশতবর্ষ উৎসব দেশের সর্বত্র পালিত হচ্ছে।