Translate

মাইকেল মধুসূদন দত্তের জীবনী (Biography of Michael Madhusudan Dutta)

মাইকেল মধুসূদন দত্তের  জীবনী

 ঊনবিংশ শতাব্দীর নবজাগরণের যুগে বঙ্গ সাহিত্যে মধুসূদন দত্তের আবির্ভাব হয়েছিল নূতন জীবনমন্ত্র তেজ ও বীর্যের পূর্ণবেগ নিয়ে। তাঁর জীবন কাহিনী তাঁর বর্ণময় সাহিত্যের মতই ছিল বহু বিচিত্র ও বিস্ময়কর।

 যশোহর জেলার সাগরদাঁড়ি গ্রামে ২৫ শে জানুয়ারি ১৮২৪ সালে মধুসূদনের জন্ম হয়। মধুসূদনের বাবা রাজনারায়ণ দত্ত একজন অবস্থাপন্ন উকিল ছিলেন। মধুসূদনের মা জাহ্নবীদেবী ছিলেন শিক্ষিতা মহিলা। প্রায় সাত বছর বয়স পর্যন্ত মধুসূদন মায়ের কাছেই লেখাপড়া করেন।

সাত বছর বয়সে মধুসূদন কলকাতায় আসেন। এখানে এসে প্রথম দুবছর তিনি খিদিরপুর স্কুলে পড়েন। ১৮৩৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি হিন্দু কলেজে ভর্তি হন। মধুসূদন খুব মেধাবী ছাত্র ছিলেন। স্কুলের পরীক্ষায় প্রতি বছর তিনি বৃত্তি পেতেন ।

এই কলেজেই তিনি সহপাঠী হিসেবে পেয়েছিলেন ভূদেব মুখোপাধ্যায়, রাজনারায়ণ বসু, গৌরদাস বসাক, ভোলানাথ চন্দ্ৰ প্রমুখদের। পরবর্তীকালে তাঁরা সকলেই স্ব স্ব ক্ষেত্রে খ্যাতিমান হয়েছিলেন।

মধুসূদনের ব্যক্তিগত চরিত্র গঠনে হিন্দু কলেজের শিক্ষাপর্বের প্রভাব ছিল অত্যন্ত গভীর। একদিকে তিনি যেমন লাভ করেছিলেন মানব-মন্ত্রে বিশ্বাস ও গভীর ইংরাজি সাহিত্য-প্রীতি; তেমনি তাঁর মনে সঞ্চারিত হয়েছিল দেশীয় আচার ও ভাবনার প্রতি অশ্রদ্ধা ।

কলেজে পড়ার সময় একটা প্রবন্ধ প্রতিযোগিতায় মধুসুদন স্বর্ণপদক পেয়েছিলেন। সেই সময় থেকেই মধুসুদন ইংরেজিতে কবিতা লিখতেন। সে সময়কার ইংরেজি পত্রিকায় এসব কবিতা প্রকাশিতহত। ছেলেবেলায় মধুসূদন মায়ের মুখে রামায়ণ পাঠ শুনতেন। তখন থেকেই কবিতার সুর ও ছন্দের প্রতি মধুসূদনের বড় আকর্ষণ ছিল।

মধুসূদন যে সময়ে কলেজে পড়তেন, সে সময়টা আমাদের দেশে ইংরেজি শিক্ষার যুগ। এ যুগের অনেক ইংরেজি-শিক্ষিত যুবক মনে করতেন -- ইংরেজদের ভাষা, ইংরেজদের আচার আচরণ, ইংরেজদের ধর্মই শ্রেষ্ঠ। মধুসুদনও তাই ইংরেজিতেই কবিতা লিখতেন, মনেপ্রাণে ইংরেজ হতে চাইতেন। ১৮৪৩ খ্রিস্টাব্দে ৯ ফেব্রুয়ারি ঊনিশ বছর বয়সে মধুসূদন খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেন। তখন তাঁর নাম হয় মাইকেল দত্ত।

শিক্ষকতার চাকরি নিয়ে মধুসূদন মাদ্রাজে গিয়েছিলেন। সেখানে তিনি ফরাসি মহিলা হেনরিয়েটাকে বিয়ে করেছিলেন। এবং অনেক ইংরেজি কবিতা ও কাব্য লিখেছিলেন। Timothy Penpoem ছদ্মনামে সনেট গীতি কবিতা ও খণ্ডকাব্য এই সময় তিনি লিখেছিলেন। The Visions of the past, The Cap tive Lady নামক দুটি দীর্ঘ কবিতা একসঙ্গে পুস্তকাকারে মাদ্রাজ থেকে প্রথম প্রকাশিত হয় ১৮৪৯ খ্রিষ্টাব্দে। কিন্তু সুনাম অর্জন করতে পারেননি। অবশেষে মধুসূদন কলকাতায় ফিরে আসেন। কলকাতায় এসে তিনি বাংলায় অনেক নাটক, কবিতা ও কাব্য লেখেন। এগুলির মধ্যে মেঘনাদ বধ কাব্য শ্রেষ্ঠ।

১৮৬২ খ্রিস্টাব্দে ৯ই জুন প্রায় আটত্রিশ বছর বয়সে মধুসূদন ব্যারিস্টারি পড়তে বিলেত গিয়েছিলেন। সেখানে একবার তিনি খুব অর্থ-কষ্টের মধ্যে পড়েছিলেন। তখন, বিদ্যাসাগর মহাশয় তাঁকে টাকা পাঠিয়েছিলেন। পাঁচ বছর পরে ১৮৬৫ খ্রিস্টাব্দে ব্যারিস্টারি পাশ করে ১৮৬৭ খ্রি: ফেব্রুয়ারি মাসে মধুসুদন দেশে ফিরে আসেন।

বাংলা সাহিত্যে অমিত্রাক্ষর ছন্দের সৃষ্টিও আকস্মিক ঘটনা। রাজা যতীন্দ্রমাহন ঠাকুর বলেছিলেন ফরাসী ভাষার মতো উন্নত ভাষায় অমিত্রাক্ষর ছন্দ রচনা করা হয়নি। সুতরাং বাংলাভাষার মতো সরলভাষায় অমিত্রাক্ষরের গাম্ভীর্য প্রকাশ করা সম্ভব নয়। প্রসঙ্গত গুপ্ত কবির ব্যঙ্গ রচনার কথাও তিনি উল্লেখ করেছিলেন --

                                                       'কবিতা কমলা কলা পাকা যেন কাঁদি 

                                                                                    ইচ্ছা হয় যত পাই পেট ভরে খাই।”

মধুসুদন জবাব দিয়েছিলেন — এটাই একমাত্র কারণ নয় যেহেতু বৃদ্ধ ঈশ্বরগুপ্ত অমিত্রাক্ষর রচনা করতে পারেন নি বলে আর কেউ পারবে না।

মধুকবি আরও বলেছিলেন যে অল্প সময়ের মধ্যে যদি তিনি তাঁর ভুল ভাঙ্গাতে না পারেন তবে যেন তাঁকে গাধা বলে ডাকা হয় ।

কবি তাঁর বিশ্বাস, আত্মপ্রত্যয়, অনমনীয় দৃঢ়তা আর অমিত্রাক্ষর ছন্দের গূঢ়তত্ত্বের উপলব্ধির বলে পুরোপুরি অমিত্রাক্ষর ছন্দে লিখলেন ‘তিলোত্তমাসম্ভব' কাব্য। এতদিন বাংলা কাব্যভারতী পয়ারের বেড়ীতে শৃঙ্খলাবদ্ধ ছিল। আজ তাঁর মুক্তি ঘটলো। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এ এক যুগান্তকারী ঘটনা। তিলোত্তমা সম্ভব' - এ যে অমিত্রাক্ষর ছন্দের পরীক্ষা তার পরিণতি লাভ ঘটলো মধু কবির অমর কাব্য ‘মেঘনাদ বধ কাব্যে' । বাংলা শব্দভান্ডার থেকে জানা অজানা শব্দ চয়ন করে তিনি এত সুন্দরভাবে এ-কাব্যে ব্যবহার করলেন যে করুণ ও বীররসের গঙ্গা-যমুনার সঙ্গম -তীর্থস্বরূপ হয়ে উঠলো এ কাব্য। এই কাব্যে কবি রাক্ষসবীর রাবণ ও মেঘনাদকে রাক্ষস রূপে আঁকেন নি। সকলকেই মানুষরূপে, ভাগ্যবিড়ম্বিত রূপে এঁকেছেন। তারা আমাদের সহানুভূতি পেয়েছে। ঊনবিংশ শতাব্দীর নব-রামায়ণ সৃষ্টি হয়েছে।

এরপর কবি সৃষ্টি করলেন 'ব্রজাঙ্গনাকাব্য', ‘বীরঙ্গনা কাব্য” এবং ‘চতুর্দশ পদী কবিতাবলী'। কিন্তু এত সৃষ্টি করেও কবি আশানুরূপ খ্যাতি বা যশ লাভ করতে পারেন নি। পুস্তক বিক্রয়ের আয়, আদালতের চাকরী ও পৈতৃক সম্পত্তি অমিতব্যয়ী মধুসূদনের অর্থাকাঙ্খা মিটাতে পারে নি। ব্যক্তিগত জীবনেও তিনি খুব শান্তি পান নি। এই ব্যর্থতারই করুণ কাহিনী তাঁরই লেখা 'আত্মবিলাপ' কবিতায় বাণীরূপ লাভ করেছে।

এদিকে কবির আর্থিক অবস্থা চরমে পৌঁছুলো। দারিদ্র্য কবিকে ক্রমশঃ গ্রাস করতে লাগলো। তাঁর স্ত্রী হেনরিয়েটা অসুখে পড়লেন; কবিও অসুস্থ হয়ে পড়লেন। দুজনেই শয্যা নিলেন। ছেলে মেয়েদের দেখাশুনার কেউ নেই। বন্ধু-বান্ধব কিছু কিছু অর্থ সাহায্য করলেন। কিন্তু তা সিন্ধুতে বিন্দুর সামিল। এদিকে পাওনাদারেরা দিনের পর দিন তাগাদা করতে লাগলো। কবিকে উত্তরপাড়ার জমিদার জয়কৃষ্ণ মুখুঞ্জে কিছুদিন নিজের বাড়িতে নিয়ে গিয়ে রাখলেন। কবির অবস্থা দিনের পর দিন খারাপ হতে লাগলো। উত্থানশক্তি রহিত হল। বন্ধুরা কবিকে এনে আলিপুর দাতব্য চিকিৎসালয়ে ভর্তি করে দিলেন।

১৮৭৩ খ্রি: ২৯শে জুন কবির জীবন-সঙ্গিনী হেনরিয়েটা মারা গেলেন। হেনরিয়েটার মৃত্যুতে কবি ভীষণভাবে ভেঙ্গে পড়েন। তিন দিন পরে তিনিও হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন। সে দিনটি হল ১৮৭৩ খ্রিষ্টাব্দের ২৯ শে জুন রবিবার। বঙ্গ ভারতীর দামাল পুত্র কবি মধুসুদন ভিক্ষুকের মতো নিঃস্ব অবস্থায় আলিপুর, কলকাতার এক হাসপাতালে পরলোক গমন করেন। এ প্রসঙ্গে কবিবন্ধু নবীন সেনের বিলাপ স্মরণীয়

                                        “অযত্নে মা অনাদরে 

                                           বঙ্গ কবিকুলেশ্বরে

                                            ভিক্ষুকের বেশে মাতঃ দিয়াছ বিদায়।'

 কবির দেহ সমাধিস্থ করা হল কলকাতার লোয়ার সার্কুলার রোডের সমাধিক্ষেত্রে। তাঁর সমাধিক্ষেত্রে কবির নিজেরই লেখা একটি কবিতা স্মৃতিফলকে খোদিত করে দেওয়া হল

                                         “দাঁড়াও, পথিকবর। জন্ম যদি তব 

                                           বঙ্গে! তিষ্ঠ ক্ষণকাল! এ সমাধিস্থলে 

                                            (জননীর কোলে শিশু লভয়ে যেমতি বিরাম) 

                                              মহীর পদে মহানিদ্রাবৃত দত্ত কুলোদ্ভব কবি শ্রীমধুসুদন । 

                                               যশোরে সাগরদাঁড়ি কপোতাক্ষ তীরে 

                                                জন্মভূমি, জন্মদাতা দত্ত মহামতি 

                                                     রাজনারায়ণ নামে, জননী জাহ্নবী!

কবি মধুসূদন আর এ পৃথিবীতে নেই। কিন্তু তিনি যে নবযুগের সৃষ্টি করেছিলেন, অরুণোদয়ের যে রক্তিম আভা নিয়ে বাংলা সাহিত্যাকাশে উদিত তা তাঁর কাব্যের মাধ্যমে আজও অম্লান হয়ে রয়েছে। বাঙালীর হৃদয়মন্দিরে কবি মধুসূদনের নাম চিরকাল স্বর্ণাক্ষরে লিখিত থাকবে।