
১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দে কোম্পানি দেওয়ানি লাভের পর বাংলা দ্বৈত শাসন চলেছিল ১৭৭২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত | ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৭৭২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বাংলা দ্বৈত শাসন চলেছিল | এই সময়ে ব্রিটিশ কোম্পানির একমাত্র লক্ষ্য ছিল যত বেশি সম্ভব রাজত্ব আদায় করা | দেওয়ানী ও দ্বৈত শাসনের চূড়ান্ত পরিনাম ছিল বাংলায় 'ছিয়াত্তরের মন্বন্তর'| দ্বৈত শাসনের দায়িত্বহীনতার ফলে বাংলার জনজীবনে একদিকে যেমন অরাজগতা নেমে ছিল তেমন অন্যদিকে অবাধ লুন্ঠুন ও যথেচ্ছভাবে রাজত্ব আদায়ের ফলে গ্রাম্য জীবন ধ্বংস হয়ে যাচ্ছিল | একই সঙ্গে পরপর দু'বছর অনাবৃষ্টি ও খরা দেখা দিয়েছিল | ফলে ১১৭৬ বঙ্গাব্দ অর্থাৎ ১৭৭০ খ্রিস্টাব্দে বাংলায় এক ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ ও মহামারী দেখা দিয়েছিল | এটি ইতিহাসে ছিয়াত্তরের মন্বন্তর নামে পরিচিত | এই সময় টাকায় এক মন থেকে চালে মূল্য বেড়ে গিয়ে তিন সেরে এসে দাঁড়ায় | খোলা বাজারে খাদ্যশস্য বেশি লাভের আশায় কোম্পানির কর্মচারীরা মজুদ শুরু করে | ফলে খাদ্যের অভাবে মোট জনসংখ্যার এক তৃতীয়াংশ মারা যায় | দলে দলে সাধারণ মানুষ শুধু খাবারের আশায় কলকাতা ঢাকা ও মুর্শিদাবাদ এর দিকে ছুটতে থাকে তবে কোম্পানির পাশবিক নীতির মুখে এই সময়েও খাজনা মুকুব করা হয়নি, ইংল্যান্ডের ভয়াবহ ব্ল্যাক ডেথের মতো এই দুর্ভিক্ষের মৃত্যু থাবা ছড়িয়ে পড়েছিল সর্বত্র|
ছিয়াত্তরের মন্বন্তর ছিল এক অর্থে ভয়ংকর এবং সর্বনাশা | এর ফলে গ্রাম বাংলা প্রায় জনশূন্য হয়ে যায় | এই বৃক্ষে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত জেলাগুলি ছিল নদীয়া রাজশাহী বীরভূম বর্ধমান যশোহর মালদহ পূর্ণিয়া ও 24 পরগনা | অন্যদিকে বরিশাল ঢাকা ফরিদপুর নোয়াখালী ও চট্টগ্রামে বিশেষ ফসলহানি হয়নি ফলে এখানে দুর্ভিক্ষের প্রকোপ তেমন একটা ছিল না | তাছাড়া 'নাজাই' প্রথার প্রকোপ থেকে নিজেদের রক্ষা করা জন্য কৃষকরা ভিটেমাটি ছেড়ে পালায় | 'নাজাই' প্রথার অর্থ ছিল, কোন একজন রাজত্ব বাকি ফেললে সেই গ্রামের অন্য কৃষকদের সেই রাজত্ব দিতে হতো | এই বিশেষ কারণে মন্বন্তরের ফলে বহু কৃষক মারা যাওয়ায় তাদের বকেয়া রাজত্বের দায়িত্ব জীবিত কৃষকদের উপর বর্তায় | এই চাপ বহন করতে না পেরে বহু কৃষক জমির স্বত্ব ছেড়ে সরাসরি পাইকে পরিণত হয় |
সামগ্রিকভাবে কৃষির অবনতি ও অনাবৃষ্টির ফলে এই ভয়াবহ দুর্যোগ বাংলার জনজীবনকে গ্রাস করেছিল। এই সর্বগ্রাসী দুর্ভিক্ষের চিহ্ন বাংলায় প্রায় ২০-২৫ বছর পর্যন্ত বিদ্যমান ছিল | দুর্ভিক্ষে অনেক মানুষের প্রাণহানির পর শেষ পর্যন্ত দ্বৈত শাসনের অবসান ঘটে | কোম্পানির রাজত্ব আহরণ থেকে আয় কমে যায় | তাদের ব্যবসা-বাণিজ্যেও মন্দা দেখা দেই | তাই কোম্পানির স্বার্থ রক্ষার পাশাপাশি ইংল্যান্ডের কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে বাংলার কৃষি ও শিল্পকে বাঁচাতে নানা উদ্যোগ নিতে দেখা যায় | এইজন্য ইংল্যান্ড থেকে দ্বৈত শাসন লোপ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল | যার অংশ হিসেবে কোম্পানির রাজত্ব আহরণ ও শাসনের দায়িত্ব প্রত্যাহার করে নিতে ওয়ারেন হেস্টিংসকে নির্দেশ দেওয়া হয় অবশেষে নানা কুফল যাচাই করে 1772 খ্রিস্টাব্দে দ্বৈত শাসন ব্যবস্থা বিলুপ্ত করা হয় |